পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু জগত্গুলোর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য, যার কোনো অংশীদার নেই। এ কথার প্রতিই আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬২-১৬৩)
এ আয়াত থেকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের পরিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তবে তার আগে প্রয়োজন ইবাদতের অর্থ বুঝে নেওয়া। ইবাদত হলো কোনো কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর বিধান অনুযায়ী করা; সাওয়াব ও প্রতিদান লাভের জন্য করা। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করাই যথেষ্ট নয়; বরং আবশ্যক হলো আল্লাহর নির্দেশ ও শরিয়তের বিধান মোতাবেক হওয়া। এই আমলের ক্ষেত্রে কোনো সুন্নত প্রমাণিত হলে সে অনুযায়ী করা, আল্লাহর এ আমলের যে সাওয়াব ও প্রতিদান ঘোষণা করেছেন তা পাওয়ার বিশ্বাস রাখা। এসব বিষয় মানুষের ‘আদাত’ (অভ্যাস)-কে ইবাদতে পরিণত করে। আর ইবাদতের এ প্রাণসত্তা বেরিয়ে গেলে নিছক অভ্যাস, প্রথা ও প্রবৃত্তি পূজায় পরিণত করে।
উল্লিখিত আয়াতটি অর্থ ও মর্মের বিবেচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এটাই ছিল মুসলিম সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অতঃপর তাদের অধঃপতনের সময় শুরু হলো। তাদের মধ্যে বিকৃতি ও বহিরাগতদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, যারা ধর্মান্তর হয়ে মুসলিম হয়েছিল তাদের সাংস্কৃতিক ক্রীয়াশীল হয় এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গোত্রীয় রীতিনীতি প্রাধান্য পায়, তখন মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় জীবনে বিভাজন রেখা টেনে দেয়। তারা বলতে শুরু করে, ইবাদত আল্লাহর জন্যই করব, আর অবশিষ্ট জীবন হবে স্বাধীন। ধর্মের যতটুকু ‘কল্যাণকর’ ততটুকু গ্রহণ করব, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা স্বাধীন। আমার যতটুকু ইবাদত করা হচ্ছে তাতেও নিয়ত বিশুদ্ধ নয়, তা আল্লাহর জন্য করা হচ্ছে না; বরং প্রথা, প্রয়োজন ও লোকলজ্জার ভয়ে করা হচ্ছে।
এমনকি প্রাচীন রোমান ক্যাথলিকদের মতো কেউ কেউ বলছে, ‘চার্চের প্রাপ্য চার্চকে বুঝিয়ে দাও আর কাইজারের প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দাও।’ আর বণ্টন যখন স্রষ্টা ও রাষ্ট্রের ভেতর করা হচ্ছে, তখন স্রষ্টার অংশ কমে যাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের অংশ বেড়ে যাচ্ছে। তারা মুখে বলে ধর্ম ধর্মের জায়গায় থাকবে এবং সমাজ-রাষ্ট্র নিজ নিজ জায়গায় থাকবে। কিন্তু তাদের অন্তর সত্যপ্রকাশের ভয়ে ভীত থাকে। কেননা প্রকৃতার্থে তাদের জীবনে ধর্মের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো স্থান নেই। মুখে তারা যা-ই বলুক, পার্থিব জীবনই চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরিণতিতে ইসলাম অন্যান্য আসমানি ধর্মের মতো কিছু ইবাদত ও বিশ্বাসে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর মুসলমানের প্রায় পুরো জীবন দুনিয়াদারি, বস্তুপূজা, সম্পদের পূজা, শক্তির পূজায় পরিণত হয়েছে। তা ধর্মের বন্ধনহীন ও প্রভাবমুক্ত। ধর্ম এখন তাত্ত্বিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এই তত্ত্বকথার আলোচনা হয়; কিন্তু জীবনে বাস্তবায়ন হয় না। যেমন খ্রিস্টানরা সপ্তাহে এক দিন চার্চে গিয়ে সামান্য কিছু প্রথা পালন করার পর স্বাধীন হয়ে যায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ধর্মপালনের এই বিকৃত রূপ পাল্টে দিয়েছেন। জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা দিয়েছেন, পুরো জীবন আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছেন। মুমিনের জীবনচিত্র হলো তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সেখানে কোনো অংশ নেই। ফলে মুমিন পানাহারে পুরোপুরি স্বাধীন নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যেসব শোভার বস্তু ও পরিশুদ্ধ জীবিকা সৃষ্টি করেছেন তা কে হারাম করেছেন?’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩২)
অর্থাৎ মুমিন জীবনোপকরণ গ্রহণ করবে, তবে তা অবশ্যই পরিশুদ্ধ হতে হবে। একইভাবে মুমিন যখন কোনো কাজ করবে, তখন সে আল্লাহর বিধানের আলোকে তা যাচাই করে নেবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে। আর এতে মুমিনের পুরো জীবন ইবাদতে পরিণত হবে। আর এ মর্মই উচ্চারিত হয়েছে ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু জগত্গুলোর প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য’ আয়াতে। এটা অনেক বড় কথা যে পুরো জীবন ইবাদতে পরিণত হবে। আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পুরো জীবনকে ইবাদতে পরিণত করেছিলেন, তাঁর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর জীবনকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। আর আল্লাহর জন্য তাঁর নিবেদন এত বেশি নিষ্ঠাপূর্ণ ছিল যে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর জবানিতে তা প্রকাশ করেছেন এবং অনাগত মানুষের জন্য তা স্মরণীয় ও বরণীয় করেছেন। যেমন মুমিন তা পাঠ করে এবং নিজের ইবাদত, বন্দেগি, জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর জন্য নিবেদন করে।
উল্লিখিত আয়াতে ব্যবহৃত ‘নুসুখ’ শব্দটিও ব্যাপকার্থক। যার মধ্যে আল্লাহবিমুখতা, আল্লাহভীতি, কোনো কাজ করা বা না করা, দান ও উৎসর্গ সব কিছু তার অন্তর্গত। কিন্তু বান্দার সব কিছু কেন আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে হবে? তিনি কেমন? উত্তরও রয়েছে আলোচ্য আয়াতে। এমন আল্লাহ যার ক্ষমতা, রাজত্ব, প্রভুত্ব, সত্তা, গুণাবলি কোনো কিছুতে কোনো শরিক বা অংশীদার নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ যেমন অংশীদারহীন তেমন আল্লাহর জন্য সব যা কিছু করা হবে, তা হতে হবে নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ, তা হবে শুধু তার জন্যই। কোনো বান্দা যদি দাবি করে সে আল্লাহতে বিশ্বাসী, তার প্রতি অনুগত তবে তার পুরো জীবন আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে হবে। বিনিময়ে প্রতি কাজের বিপরীতে সে সাওয়াব ও পুরস্কারের যোগ্য হবে।