পবিত্র কাবা শরীফের কালো পাথর যেটি ‘হাজরে আসওয়াদ’ নামে পরিচিত। এটি কোনো সাধারণ পাথর নয়; বরং প্রতিটা মুসলমানের সাথে এই পাথরটির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই পাথরটি পবিত্র কাবা শরীফের পূর্ব কোণে অবস্থিত।
বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা যখনই হজ্জ্ব বা ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে কাবা শরীফ পরিদর্শন করে তখন সকলেই জান্নাত থেকে আসা এই মূল্যবান পাথরটি চুম্বন করার চেষ্টা করে। মহামূল্যবান এই পাথরটি বর্তমানে একটি রুপার ফ্রেমে নিরাপদে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। যারা এটিকে দেখতে যান তারা ফ্রেম খোলার মাধ্যমে এটিকে পুরোপুরি দেখতে পাবেন।
এই পাথরটি মুসলমানদের নিকট পবিত্র হিসাবে বিবেচিত হয়, যেহেতু এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বারা পুনঃস্থাপিত হয়েছে এবং এটিকে আল্লাহ তা’আলা জান্নাত থেকে বরকতস্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এটি পবিত্র কাবা শরীফের ভিত্তি প্রস্তর হিসেবেও পরিচিত।
হাজরে আসওয়াদ কারা চুরি করেছিল?
অনেকেই হয়ত এটি জানেন না যে, মক্কা থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথরটি চুরি করা হয়েছিল এবং দীর্ঘ ২৩ বছর পর পাথরটি আবার কাবা শরীফে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়! ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কারমাতিয়ানরা এটি চুরি করেছিল। কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির আল-কারমতি পাথরটি চুরি করে সেখান থেকে হাজারবেসে (বর্তমানে, বাহরাইন) নিয়ে গেছিল।
আবু তাহির আল-কারমতি প্রাচীন বাহরাইনের কারমতি রাজ্যের শাসক ছিল। তার ভাই আবু সা’দ হাসান ইবনে বাহরাম ছিল আল-জান্নাবী ছিল কারমাতিয়ান রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার মৃত্যুর পর আবু তাহির আল-কারমতি ৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কারমাতিয়ানদের নেতা নির্বাচিত হয়।
তাঁর শাসনামলে রাজ্যের কিছুটা বিস্তৃতি ঘটেছিল। সে ৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় এবং ৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে কুফায় দখলদারিত্বের জন্য অভিযান চালিয়েছিল। সে বাগদাদ দখলের জন্যও হুমকি দিয়েছিল এবং ইরাকের বেশিরভাগ অঞ্চল সে দখল করে নিয়েছিল। তৎকালীন জামানায় তাকে কেউ শান্তিপূর্ণ নেতা হিসাবে বিবেচনা করেনি।
যেভাবে কারমাতিয়ানরা হাজরে আসওয়াদ চুরি করেছিল
৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির একটি ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা করেছিল। সে পবিত্র মক্কা নগরী আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। সে যখন প্রথম মক্কা নগরীতে পৌঁছাল, তখন তাকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল না। এ কারণে সে মক্কা নগরীতে কোনো অশান্তি সৃষ্টি করবে না এই শর্তে মক্কায় প্রবেশ করেছিল।
তবে মক্কা প্রবেশের পর সে তার শপথ রক্ষা করেনি। সে মক্কায় প্রবেশের পর যা করেছিল তা মোটেও কোনো শান্তির বার্তা ছিল না। হজ্জ্বের প্রথম দিনেই তার পরিকল্পনা মত কারমাতিয়ানরা পবিত্র মক্কা নগরীকে আক্রমণ করে বসে। কারমতিয়ানদের সেনাবাহিনী তাদের ঘোড়া নিয়ে এসে মসজিদ আল হারামে প্রবেশ করে।
এরপর তারা হজ্জ্বপালকারীদের নির্মমভাবে গণহত্যা শুরু করে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কাবাকে ঘিরে নামাজ পড়তে গিয়ে প্রায় ৩০,০০০ হজ্জ্বপালনকারী সে সময় নিহত হয়েছিল।
কারমতিয়ানরা পবিত্র কুরআনের আয়াত নিয়ে কটাক্ষ করছিল আর হজ্জ্বপালনকারীদের হত্যা করে যাচ্ছিল।
তারা পবিত্র কাবা ঘর লুট করেছিল, অনেকগুলি ভবন ধ্বংস করেছিল, কাবার আশেপাশের বাড়িঘর পর্যন্ত তারা লুট করেছিল, দাসদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং হজ্জ্বপালনকারীদের মৃত দেহগুলি জমজমের কূপের পানির মধ্যে এবং কাবার রাস্তার মধ্যে ফেলে গিয়েছিল।
কেন এই চুরি?
কারমানতিয়ানদের নেতা আবু তাহির কাবা থেকে হাজরে আসওয়াদ পাথরটি ছিনিয়ে নিয়ে তার নিজের দখলদারিত্বের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। সে এটি কাবা থেকে চুরি করে নিয়ে ‘মসজিদ আল দিরার’ এ নিয়ে গিয়েছিল যাতে এটিকে সেখানে স্থাপন করা যায়। সে ‘মসজিদ আল দিরার’ কে একটি পবিত্র স্থান হিসাবে তৈরি করতে চেয়েছিল এবং কাবা শরীফকে বাদ দিয়ে মসজিদ আল দিরার কে হজ্জ্বের স্থান হিসেবে পুনর্নির্দেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার এই দুরভিসন্ধি এক মুহূর্তের জন্যও বাস্তবায়ন হয় নি।
এ সকল অন্যায়-অত্যাচারের জন্য সে এমন ভয়াবহ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছিল যে, তাঁর শরীরের সকল মাংসপিন্ড কৃমি বা পোকায় ভক্ষণ করেছিল। হাজরে আসওয়াদ চুরি হওয়ার দীর্ঘ ২৩ বছর পর বিশাল মুক্তিপণের বিনিময়ে পাথরটি আবার কারমাতিয়ানদের নিকট থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল।
আব্বাসীয় শাসনামলে হাজরে আসওয়াদকে ফিরিয়ে এনে আবার পবিত্র কাবা শরীফের আগের স্থানে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এই হস্তান্তরের সময় পাথরটি সাতটি টুকরাতে ভেঙ্গে গিয়েছিল।