ইউরোপের ইতিহাসের দিকে নজর ফেরালে দেখা যায় অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামের ইতিহাসও সেখানে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু স্পেন নয়, পর্তুগাল, দক্ষিণ ফ্রান্স, ইতালির কিছু অংশ, গ্রিস, আলবানিয়া প্রভৃতি দেশেও ইসলামের প্রসার ছিল নজরে পড়ার মত। এই দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল ভূমধ্যসাগরের মালটা দ্বীপ।
মালটা দ্বীপ বিজয়ের কাহিনীঃ
আনুমানিক ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে ও সিসিলি দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম ধর্মের প্রসার শুরু হয়। এই প্রসারের শুরুর গল্পটি বেশ অন্যরকম। বাইজান্টিয়ন সাম্রাজ্যের একমেবাদ্বিতীয়ম সম্রাট দ্বিতীয় মিখায়েলের সঙ্গে বাইজান্টিয়ন শহরের তৎকালীন নৌসেনাপতি ইউফেমিয়াসের প্রবল সংঘাত শুরু হয়। সংঘাতের কারণ অবশ্য হৃদয় ঘটিত। ইউফেমিয়াস বাইজান্টিয়ন শহরের কনভেন্ট থেকে এক সন্ন্যাসিনীকে অপহরণ করে বলপূর্বক বিবাহ করেন। এতে সম্রাট ক্ষুব্ধ হন ও ইউফেমিয়াসকে আটক করার নির্দেশ দেন সিসিলি দ্বীপের শাসককে।
তিনি নাকি ইউফেমিয়াসের নাক কেটে দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে ইউফেমিয়াস সিসিলি দ্বীপের শাসককে হত্যা করে ও নিজেকে সাইরাকুজের শাসক বলে ঘোষণা করে। এতে সম্রাট দ্বিতীয় মিখায়েল আরও ক্ষুব্ধ হয়ে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পাঠান ইউফেমিয়াসকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে। এতে ভয় পেয়ে ইউফেমিয়াস ইফ্রিকিয়া( বর্তমানের টিউনিশিয়া)-র ইসলাম শাসকের কাছে সাহায্য চেয়ে বসে। বিনিময়ে মালটা ও সিসিলির শাসনভার অর্পণ করতে রাজি হয়।
যে সমস্ত মুসলমান শাসকের কাছে ইউফেমিয়াস সাহায্য চেয়েছিলেন তারা আঘলাবি রাজবংশের অন্তগর্ত। এই রাজবংশ আব্বাসাইদ বংশের অধীনে থাকলেও ৮০১ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের স্বাধীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই সময় সেই বংশ শাসন করতেন প্রথম জিয়াদাত আল্লাহ, তিনি ইউফেমিয়াসের অনুরোধ স্বীকার করেন ও এই অভিযানের ভার দেন সত্তর বছর বয়স্ক কাজী আসাদ ইবদুন আল ফুরতকে। তিনি ছিলেন ইমাম মালিকের যোগ্য ছাত্র। জিয়াদাতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বেশ সমালোচনা করতেন আসাদ, সম্রাটের সভায় তিনি প্রতিপক্ষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
সম্রাট জিয়াদাত দেখলেন এই সুযোগ, আসাদকে এই অভিযানে পাঠিয়ে দিলে এক ঢিলে দুই পাখি হয়ে যাবে। আসাদ বাহিনী নিয়ে সিসিলির দিকে এগোনোর পথে বিপর্যয় ঘটে। মড়ক শুরু হয় এবং সৈন্যদের বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। তখন আঘলাবিরা করডোবার উম্মাইয়দ শাসকের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। অতঃপর মুহাম্মদ আসবাগের নেতৃত্বে আঘলাবি ও উম্মাইয়দ রাজবংশ একযোগে সিসিলি ও মালটা আক্রমণ করে। এইভাবেই সিসিলিতে ইসলামের শাসন শুরু হয় যা প্রায় দু’শ বছর ধরে চলেছিল। অন্যদিকে আহমদ উমর উবাইদল্লাহ হয়েছিলেন মালটার শাসক।
মালটা দ্বীপ ও নরম্যানদের ইতিহাসঃ
৮৭০ থেকে ১০৯১ সন পর্যন্ত মালটায় ইসলামিক শিল্প, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের ধারাই প্রকট ছিল। জনসাধারণের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মূলত প্রচলন ছিল। মালটার মূল ভাষা ছিল তখন আরবী। ১০৯১ -এ মালটা দখল করে নরম্যানরা, তথাপি মালটা ও সিসিলিতে ইসলাম ধর্মে কোনও আঁচ লাগেনি। সেখানকার মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম ও বিশ্বাস বজায় রেখেই জীবনযাপন করতে পারতেন।
নরম্যান শাসক দ্বিতীয় রজারের সময় মালটাতে অভূতপূর্ব ভাবে সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক নিদর্শন দেখা যায়। নরম্যান, আরব মুসলমান, বাইজান্টাইন গ্রিক ও সিসিলির স্থানীয় অধিবাসীরা একসঙ্গে বাস করত নিজেদের আলাদা ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে।
মুসলমান বিদ্বজন ও লেখকরা নরম্যানদের এই উদারতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। ইবন আথির এই বিষয় নিয়েই লিখেছিলেন,
‘ মুসলমানদের যথাযথ সম্মান দেওয়া হত, এমনকি বহিঃশত্রুর থেকে তাঁদের রক্ষা করা হত। এই সব কারণে মুসলমানরা সম্রাট রজারকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।’
দ্বিতীয় রজার যতটা উদার ছিলেন, দ্বিতীয় ফ্রেডরিক ঠিক ততটা উদার ছিলেন না। সিসিলিতে ধর্মযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিতেই ১২২৪ সনে মুসলমানদের নির্বাসিত করেন তিনি। নির্বাসিত মুসলমানেরা লুসেরাতে কলোনি পত্তন করে। মালটা দ্বীপ ও অটোমানদের ইতিহাসঃ
ষোড়শ শতকে অটোমান তূর্কিদের জন্য মালটা দ্বীপ পুনরায় ইসলাম শাসনের অন্তর্গত হয়। ১৫২২ সনে সুলতান সুলাইমান এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রোডস দ্বীপ দখল করেন। রোডস দ্বীপ তখন ক্রিস্টান নাইটদের দ্বারা শাসিত ছিল। এই নাইটদের উৎপত্তি মূলত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ করার জন্য হয়েছিল। তূর্কিরা প্রথমেই ধর্মযুদ্ধে মূলে প্রবল আঘাত হানে। প্রায় ছয়মাস অবরোধ করে রাখার পর নাইটরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সুলতান তখন তাঁদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা নিজে থেকে করে দেন।
তারপর সুলতান মালটা দখল করার উদ্দেশ্যে আগুয়ান হন। মালটা তখন স্প্যানিশ শাসনের অন্তর্গত। যে সমস্ত নাইটেরা সিসিলি ত্যাগ করেছিল তারা তখন স্প্যানিশ সম্রাট পঞ্চম চার্লসের আনুকূল্যে মালটায় বসবাস করছে। সুলাইমান প্রায় ২০০ জাহাজ ও ৪৮০০০ সৈনিকের এক বাহিনী নিয়ে মালটা আক্রমণ করেন। প্রায় চার মাসের যুদ্ধের পর সুলাইমান জয়লাভ করেন।
মালটা দ্বীপ ও ভারতের মুজাহিদ ও উলেমাদের ইতিহাসঃ
১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও স্বাধীনতার লড়াই তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই লড়াইতে মুসলমানদের অবদানও কম নয়। বিশেষ করে ১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহের শুরু হয়েছিল মঙ্গল পান্ডের সঙ্গে সঙ্গে এক মুসলমান উলেমার যৌথ প্রয়াসে। ইতিহাসের উদাসীনতায় আজ তাঁর নাম হারিয়ে গিয়েছে। ১৮৫৭-এর বিদ্রোহের প্রায় ২০ বছর পর ১৮৭৭ সালে শিয়াকুল হিন্দ মওলানা মাহমুদ হাসান ‘সমরতাত তরবিয়ত’ নামে এক গোষ্ঠী তৈরি করেন। এই গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য ছিল তুরস্ক, আফগানিস্তান ও জার্মানির সাহায্য নিয়ে ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করা। ১৯১৬ সালে এই গোষ্ঠীর প্রায় ২০০ উলেমা ও মুজাহিদ ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হয়। মাহমুদ ও তাঁর সহযোগী মওলানা ওয়াহিদ আহমদ ফৈজাবাদী, মওলানা আজিজ গুল, হাকিম সৈয়দ, নুসরত হুসেন প্রমুখকে মালটায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। মালটা ছিল তখন ব্রিটিশদের যুদ্ধ বন্দি রাখার বন্দিশালা।
গ্রেফতার হওয়া উলেমাদের তারপর গুয়ান্তানামো বে- তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ইতিহাসের অবশিষ্টাংশঃ
যদিও এখন মালটা আর ইসলামিক শাসনের অন্তর্গত নয় তথাপি এককালে সেখানে যে এককালে ইসলামের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। এখনও বেশ কিছু জায়গায় মুসলমান ধর্মবিশ্বাসী মানুষ বসবাস করেন। মাত্র দুই শতকের জন্য বজায় থাকলেও ইসলাম নিজের প্রভাব খুব গভীর ভাবেই রেখে গিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মালটায় যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, সেই মাল্টিজ বা মাল্টি ভাষাটি আরবী থেকে উদ্ভূত। ৪০ শতাংশ আরবী শব্দ পাওয়া যায় মাল্টি ভাষায়। ভাষাবিদদের মতে, সিকূলো-আরবীয় ভাষা থেকেই মাল্টি কথ্য ভাষার উৎপত্তি।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, মাল্টি ভাষায় ঈশ্বরকে বলা হয় ‘অল্লা’ , যা ইসলামের মহান আল্লা’তালার নাম থেকে উদ্ভূত।
মহান আল্লার ইচ্ছেয় ইসলাম ধর্ম পৃথিবীর কোনায় কোনায় নিজের প্রভাব ও মণিমুক্তো রেখে এসেছে।