বিশ্বের সকল মুসলমানের কাছেই মসজিদে নববী অন্যতম একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিজ হাতে তৈরি মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত এ মসজিদটির সাথে সারাবিশ্বের মুসলমানের শ্রদ্ধা ও আবেগ মিশ্রিত হয়ে আছে।
কিন্তু আমাদের শ্রদ্ধা ও আবেগের সাথে জড়িত এই মসজিদের অনেক তথ্যই আছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই এই নিবন্ধে মসজিদে নববী সম্পর্কে অজানা কয়েকটি তথ্য উপস্থাপন করা হলো।
১)মসজিদে নববীর বর্তমান আয়তন তৎকালীন মদিনা শহর থেকেও বড়
মসজিদে নববীর বর্তমান আয়তন প্রায় ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার বর্গ মিটার। মসজিদুল হারামের পর বিশ্বের ২য় বৃহত্তম মসজিদ এটি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নির্মিত মূল মসজিদের অবকাঠামোর তুলনায় বর্তমান আয়তন একশত গুণ বড়। অর্থাৎ, তৎকালীন মদীনা শহরের চেয়েও মসজিদটি আকারে বড়। প্রায় ১৫ লক্ষ মুসল্লী একত্রে এই মসজিদে সালাত আদায় করতে পারেন।
২)রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের তৈরি মসজিদ ও শাসনকেন্দ্র
মদীনায় হিজরতের পরপরই রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে নিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। হিজরতের সময় মদীনায় প্রবেশের পর নবীজীর উটনী ‘কাসওয়া’ যে স্থানটিতে বসে পড়ে, সেই স্থানটিকেই মসজিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এই জমির মালিক ছিল সাহল ও সোহাইল নামে দুই এতিম বালক। তাদের নিকট থেকে ১০ দিনারের বিনিময়ে জায়গাটি ক্রয় করে মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের স্বেচ্ছাশ্রমে সাত মাসে মসজিদটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়। রাসূল নিজেও নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করেন।
মসজিদের সাথে ছোট একটি অংশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য বাসস্থান তৈরি করা হয়। সালাত আদায়ের পাশাপাশি এ মসজিদ থেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরও এই মসজিদ থেকে খোলাফায়ে রাশেদীন শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। আলী (রাযিঃ) এর শাসনামলে মদীনা থেকে ইসলামী খেলাফতের রাজধানী কুফায় স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত মসজিদে নববীই ছিল মুসলমানদের দ্বীনি মার্কাজ।
৩)রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মোবারক
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর মসজিদ সংলগ্ন তার বাসস্থানেই হযরত আয়েশা(রাযিঃ) এর কক্ষে তাঁকে দাফন করা হয়। তবে বর্তমানের মত রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের বাসস্থান মসজিদের সাথে এরূপ সংযুক্ত ছিল না। মসজিদের থেকে ঘরের আলাদা অবস্থান ছিল। উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের শাসনামলে মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করতে গিয়ে মসজিদের সাথে রওজাকে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।
৪)রওজার ওপরের গম্বুজ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ৬৫০ বছর পর্যন্ত তার রওজার ওপর কোনোপ্রকার গম্বুজ ছিলো না। ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মিসরের মামলুক সুলতান সাইফউদ্দীন কালাউনের শাসনামলে রাসূলের রওজার ওপরে প্রথম একটি কাঠের গম্বুজ তৈরি করা হয়। এই গম্বুজের ভেতরের দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর(রাযিঃ) এবং উমর(রাযিঃ) এর নাম অঙ্কিত আছে। এরপর ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে উসমানী সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কাঠের গম্বুজটির ওপর বর্তমান ইটের তৈরি সবুজ গম্বুজটি নির্মাণ করেন।
৫)নীল-বেগুনী গম্বুজ
মসজিদে নববীতে রওজার ওপরের বর্তমান সবুজ গম্বুজটি প্রথমে সবুজ রঙের ছিলো না। ১৮১৮ সালে এই গম্বুজটি তৈরির আগে এর নিচে থাকা কাঠের গম্বুজটি প্রথমে রঙবিহীন পরবর্তীতে সাদা রং করা হয়। ১৮১৮ সালে কাঠের গম্বুজের ওপর বর্তমান গম্বুজটি তৈরি হলে তাও প্রথম সাদা রং করা হয়। পরবর্তীতে তা তৎকালীন হিজাজী আরবদের রুচি অনুযায়ী নীল-বেগুনী রং করা হয়। ১৮৩৭ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের আদেশে প্রথম গম্বুজটি সবুজ রং করা হয়। যা অদ্যবধি বহাল আছে।
৬)রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পাশের শূন্য কবর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের পাশে হযরত আবু বকর(রাযিঃ) এবং হযরত উমর(রাযিঃ) এর কবরের পর তৃতীয় একটি কবর খালি রয়েছে, যাতে কাউকে দাফন করা হয়নি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর(রাযিঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস থেকে জানা যায়, “হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম(আঃ) যখন পুনরায় পৃথিবীতে আসবেন, তখন তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তাকে এই খালি স্থানটিতে দাফন করা হবে।
৭)রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের স্মৃতিচিহ্ন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের বাসস্থানের নিকটেই ছিল তার মেয়ে ফাতেমা(রাযিঃ) এর বাসস্থান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যবহৃত দ্রব্যসহ বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন এখানে সংরক্ষিত ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব বিদ্রোহীদের হাতে মদীনা অবরোধের মুখে পড়লে মদীনার উসমানী গর্ভনর বিভিন্ন অমূল্য সম্পদের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্নসমূহও তৎকালীন উসমানী সালতানাতের রাজধানী ইস্তানবুলে পাঠিয়ে দেন। বর্তমানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের এই স্মৃতিচিহ্নসমূহ তুরস্কের ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
৮)ছয়টি মিহরাব
অধিকাংশ মসজিদের সাধারণত একটি মিহরাব থাকে। কিন্তু মসজিদে নববীতে মিহরাবের সংখ্যা ছয়টি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সময় একটি মিহরাব তৈরি হয় এবং এখানেই তিনি নামাজ পড়াতেন। এটি ‘মিহরাবে নববী’ নামে পরিচিত।
উসমান(রাযিঃ) এর খেলাফত আমলে মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণের সময় নতুন একটি মিহরাব তৈরি করা হয়। এটির নামকরণ করা হয় ‘মিহরাবে উসমানী’।
১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে উসমানী সুলতান সুলাইমানের সময় তৃতীয় একটি মিহরাব তৈরি করা হয়। যা ‘মিহরাবে সুলাইমানী’ নামে পরিচিত লাভ করে।
এই তিনটি মিহরাব ছাড়াও ‘মিহরাবে ফাতেমী’, ‘মিহরাবে তাহাজ্জুদ’ ও ‘মিহরাবে শাইখ আল-হারাম’ নামে আরও তিনটি মিহরাব পরবর্তীতে নির্মিত হয়।
৯)রওদাতুল জান্নাত (জান্নাতের বাগান)
রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমার ঘর এবং আমার মিম্বরের মাঝে জান্নাতের বাগানের একটি অংশ আছে এবং আমার ঝর্ণার (হাউজে কাউসার) উপর আমার মিম্বার অবস্থিত।” (বুখারী)
বর্তমানে এই অংশটি বিশেষ সবুজ কার্পেটে মুড়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং এটি সংক্ষেপে রওদা নামে পরিচিত।
১০)আরব উপদ্বীপের প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রাপ্ত স্থান
১৯০৯ সালে উসমানী শাসকরা যখন আরব উপদ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেন, তখন তারা সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেন। মসজিদের সম্মানে উসমানীয় শাসকরা তাদের রাজকীয় প্রাসাদে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার পূর্বেই মদীনার মসজিদে নববীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেন।