আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন করার নিমিত্তে আদি পিতা হজরত আদম আলাইহিস সালামকে বানালেন। এরপর তাঁর থেকে তৈরি করলেন আদি মাতা হজরত হাওয়া আলাইহিস সালামকে। এটি কোরআনে কারিমে বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের সৃজন করেছেন এক সত্তা হতে এবং তা হতে বানিয়েছেন তার জোড়া এবং বিস্তৃত করেছেন তাঁদের দুজন থেকে বহু নর ও নারী।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১)।
মুসলিম জাতির কিবলা মক্কা শরিফের কাবা শরিফ, যা বাইতুল্লাহ শরিফ বা খানায়ে কাবা নামে পরিচিত। এর পুনর্নির্মাণ এবং মক্কা সভ্যতার উদ্ধারের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছেন একজন মহীয়সী নারী। নবী হজরত ইবরাহিম (আ.)–এর সহধর্মিণী ও শিশু নবী হজরত ইসমাইল (আ.)–এর মাতা হজরত হাজেরা (আ.)–এর অবদান। এ জগতে জান্নাতের নহর ‘জমজম’ কূপের সৃষ্টির সূচনাও তাঁর হাতে। তাঁরই স্মৃতি হজের গুরুত্বপূর্ণ বিধান সাফা-মারওয়া সাঈ করা বা দৌড়ানো, যা কিয়ামত পর্যন্ত সব হাজির জন্য ওয়াজিব। এই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আরেকজন নারী হজরত ইবরাহিমপুত্র নবী হজরত ইসহাক (আ.)–এর মাতা বিবি সারা।
নবী হজরত মুসা আলাইহিস সালামের প্রাণ বাঁচিয়েছেন একজন নারী। তিনি ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া (আ.); পরবর্তী সময়ে যিনি মুসা (আ.)–এর পালক মাতা হন। কোরআনের বিবরণ, ‘ফেরাউনের স্ত্রী (আছিয়া) বললেন, (এই সন্তান) চক্ষু শীতল করবে আমার ও তোমার। তাকে হত্যা কোরো না; হয়তো সে আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে বরণ করব। তারা (ফলাফল) অবগত ছিল না।’ (সুরা-২৮ কাছাছ, আয়াত: ৯)। এই শিশু মুসা (আ.) পরবর্তীকালে শ্রেষ্ঠ রাসুল চতুষ্টয়ের একজন হয়েছিলেন। তাঁরই ওপর নাজিল হয়েছিল চারখানা আসমানি বৃহৎ গ্রন্থের অন্যতম ‘তাওরাত’ কিতাব। হজরত মুসা (আ.)–এর জননী ও তাঁর বোনের অবদানের কথাও বর্ণিত হয়েছে কোরআনে। (২০: ৪০, ২৮: ১৩)।
জীবনদায়িনী হজরত আছিয়া (আ.) বিশ্বের সেরা সম্রাট ফারাও বা ফেরাউনের স্ত্রী হয়েও তাওহিদের সত্যবাণী আঁকড়ে ধরে জীবন দিয়ে মানবতার পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। রচনা করে গেছেন অনন্য ইতিহাস।
কোরআন মাজিদে সুরা আল ইমরানে উল্লেখিত হজরত ইমরান–এর স্ত্রী হান্না অনাগত সন্তান মরিয়ম (আ.)কে মানবকল্যাণে ওয়াক্ফ করলেন। যে সন্তানের মাধ্যমে নবী ঈসা (আ.)–এর আগমন ঘটেছে। কোরআনের বর্ণনা, ‘যখন বললেন ইমরানপত্নী, হে
আমার প্রভু! নিশ্চয়ই আমি আমার গর্ভস্থ সন্তানকে (মানবতার জন্য) মুক্ত ঘোষণা করলাম। আপনি আমার তরফ থেকে কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। অতঃপর যখন তিনি (হান্না) প্রসব করলেন, (কন্যাসন্তান দেখে) বললেন, হে আমার প্রভু! এ তো আমি কন্যা জন্ম দিলাম! তিনি যা কিছুই প্রসব করেছেন, আল্লাহ তা সম্যক অবগত আছেন। (আল্লাহ বলেন) আর নহে কোনো পুত্র এই কন্যার মতো।’ (সুরা-৩, আয়াত: ৩৫-৩৬)।
নবী–রাসুলদের অন্যতম মরিয়ম–তনয় হজরত ঈসা (আ.)। তিনি পবিত্র নারীর সন্তান এবং নারী মায়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ। তদীয় গ্রন্থ ইঞ্জিলে নারী ও নারী অধিকার সুরক্ষা বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। কোরআনের ভাষায়, ‘তিনি (হজরত ঈসা (আ.) বললেন, “আমি আবদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা), আমাকে কিতাব দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে নবী করা হয়েছে। আর আমাকে বরকতময় করা হয়েছে, যেখানেই আমি থাকব, আমাকে সালাত ও জাকাতের নির্দেশ করা হয়েছে যতকাল আমি বেঁচে থাকব। সর্বোপরি আমাকে মায়ের ভালো ছেলেরূপে পাঠানো হয়েছে; আমাকে রূঢ় দুর্ভাগা করা হয়নি।”’ (সুরা-১৯ মারিয়াম, আয়াত: ৩০-৩২)।
ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে যিনি দুনিয়ায় ধৈর্যের আকররূপে জগৎজোড়া সুখ্যাতি লাভ করেছেন, তিনি নবী হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম। তাঁর জীবনেও সহযোগী ছিলেন একজন হিতৈষী নারী, তাঁর স্ত্রী বিবি রহিমা (আ.)। (৩৮: ৪৪)। সুন্দর বিশুদ্ধ ও পবিত্রতম চরিত্রের জন্য জগদ্বিখ্যাত নবী হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁরও পার্শ্বচরিত্র ছিলেন একজন নারী, জুলাইখা, যঁার মাধ্যমে তাঁর পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি ঘটেছে।বিজ্ঞাপন
জগতের শ্রেষ্ঠ নারীদের ইতিহাসে আরও যুক্ত হয়েছেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম–এর মা আমিনা ও দুধমাতা হালিমা সাদিয়া; মুমিন মাতা খাদিজা (রা.), হাফসা (রা.), আয়েশা (রা.), মারিয়া (রা.)সহ নবীপত্নীরা; নবীনন্দিনী রুকাইয়া, জয়নব, কুলসুম ও ফাতিমা (রা.)। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)–এর কন্যা আসমা, ইসলামের প্রথম শহীদ ‘শাহীদা সুমাইয়া’; নবীজির দুধবোন সায়েমা; তাঁরা প্রত্যেকেই ইতিহাসে তাঁদের পদচিহ্ন রেখে গেছেন।
ইসলামের ইতিহাসে নবী পরিবারের নারীরাও বিভিন্ন সমাজসেবা ও দেশসেবার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। রোগীর সেবা–শুশ্রূষা ও যুদ্ধাহতদের পরিচর্যায় তাঁরা অনবদ্য, অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।