প্রতিদিন কতই না কষ্টকর সংবাদ পেয়ে থাকি। কোথাও নেশার টাকার জন্য মমতাময়ী মাকে সন্তান হত্যা করছে আবার কোথাও পিতাকে হত্যা করছে আদরের সন্তান।
এই যে দিনের পরদিন আমাদের সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর কারণ কি? আমরা কি কখনও এসব নিয়ে ভেবে দেখেছি? আমার মনে হয় সন্তান নষ্ট হবার মূল কারণ সুশিক্ষার অভাব।
পবিত্র কোরআন করিমে আল্লাহপাক শিক্ষাকে ‘আলো’ এবং মূর্খতাকে ‘অন্ধকার’ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত তাদেরকে ‘উৎকৃষ্ট জীব’ বলা হয়েছে, অপর দিকে যাদের শিক্ষার আলো নাই তাদেরকে ‘নিকৃষ্ট জীব এবং অন্ধ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা আদেশ করেছেন, ‘তুমি পাঠ কর কেননা তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে তা যা সে জানত না’ (সুরা আলাক, আয়াত :৩-৮)।
আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন ‘যাকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)।
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘তুমি বল যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? বস্তুত ধীসম্পন্ন লোকগণই কেবল শিক্ষা লাভ করে’ (সুরা জুমার, আয়াত: ৯)।
জ্ঞানার্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আল্লাহতায়ালা বান্দাকে দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আমার প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর’ (সুরা তাহা, আয়াত: ১১৫)। কোরআনপাকে বার বার শিক্ষালাভ সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে।
শিক্ষালাভ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালার আদেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মহানবী (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর জন্য ফরজ’ (ইবনে মাজাহ)।
তিনি (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিদ্যা শিক্ষার পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন’ (মুসলিম)।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘একজন বিশ্বাসীর জ্ঞান অন্বেষণ প্রচেষ্টা শেষ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জান্নাতে দাখিল হয়’ (তিরমিযি)।
আল্লাহতায়ালা শিক্ষাকে আলো বলেছেন, কারণ এ ‘আলো’ আঁধাররূপী সকল অজ্ঞানতা, পঙ্কিলতা, অন্যায় অনাচার দূর করে দিয়ে মানুষকে সঠিক পথ অর্থাৎ ন্যায়নিষ্ঠা ও সত্যের অনুসারী করে।
এক কথায় মানুষ হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দা! মানুষকে জ্ঞান শিক্ষা দিবার জন্যই কোরআন মজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। মানুষের মধ্যে মনুষত্ববোধ সৃষ্টি, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা, স্রষ্টা ও তার সৃষ্টি সম্পর্কে জানার জন্য কোরআন পাকে দিকনির্দেশনা রয়েছে।
কোরআন করিমের শিক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে মহানবীর (সা.) পবিত্র জীবনে। তিনি মানুষকে এই শিক্ষার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাগিদ করেছেন তা গ্রহণ করতে, এর আলোকে আলোকিত হয়ে সুফল লাভ করতে।
তাই বিশ্বনবীর (সা.) জীবনাদর্শ এবং তার মুখনিসৃত বাণী মানুষের জন্য অবশ্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। কেননা মানব ধর্ম ‘ইসলাম’কে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই মহানবীর (সা.) আবির্ভাব হয়েছে এবং আল্লাহতায়ালা তার কাছেই কোরআন অবতীর্ণ করেছেন।
শিক্ষা মানুষকে আয়ত্ব করতে হয়। জন্মের পর থেকে শিশু তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে শিখতে শুরু করে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে ও বংশগত ভাবে কতগুলো বিষয় শিশুর মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।
বিশেষ করে মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় মাতার অনেক আচরণ ও আমল শিশুর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু সাধারণ অর্থে শিক্ষার যে সংজ্ঞা, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, জন্মের পর একটি সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ‘শিক্ষা’। মানুষকে নীতিবান ও বিবেকবান করে তোলে ‘শিক্ষা’।
ইসলাম জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমনপূর্বক শিক্ষালাভকে একটি অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে তবে একে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয় না।
কেননা আল্লাহতাআলা সন্তানের জন্য পিতামাতাকে আদর্শ শিক্ষক হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং তার পক্ষ থেকে পৃথিবীতে পিতামাতা হলেন তাদের নিজ নিজ সন্তানদের অভিভাবক। কাজেই জন্মের পর থেকে পিতামাতাই হলো সন্তানের শিক্ষাগুরু।
আধুনিক যুগোপযুগী শিক্ষার ব্যবস্থাও ইসলাম কায়েম করেছে। এতে গুরুগৃহে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও পরিবারই সে যান্ত্রিক যুগে কিভাবে একটি শিশু ছোটবেলা থেকে শিক্ষা লাভ করে একজন সত্যিকার মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে সে বিধি-বিধান বা নিয়ম কানুন কোরআন পাক এবং মহানবী (সা.) এর সুন্নাহর মধ্যে নিহিত রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে ইসলাম পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। পুঁথিগত বিদ্যা অর্থাৎ তোতাপাখীর মতো মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে সনদ বা সার্টিফিকেট পাওয়া যায় বটে কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে যদি তার প্রতিফলন না ঘটে তবে সে শিক্ষার কোনো মূল্যই থাকে না।
‘শিক্ষা’ এর অর্থ হলো ‘আলো’। কাজেই যে শিক্ষা বা আলো অন্ধকার অর্থাৎ সকল প্রকার অজ্ঞতা দূর করতে ব্যর্থ হয় সে শিক্ষায় শিক্ষা লাভ করা আর না করা একই সমান।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় আমাদের সমাজে বহুল পরিচিত প্রবাদ বাক্যটির কথা, যেমন-‘বে আদপের লেখাপড়া যেমন সাপের ফণা ধরা’।
প্রবাদ বাক্যটি দ্বারা এটাই প্রতিপন্ন হয় যে, বেয়াদব কোনো শিক্ষার্থী লেখাপাড়া শিখে বড় মাপের একজন শিক্ষিত বেআদবে পরিণত হয়। সে সমাজের কোনো উপকারে আসে না বরং সমাজ তার দ্বারা কলুষিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কারণ আদব-কায়দা, মান-মান্যতা ও শিষ্টাচার বিবর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি সত্যিকার মানুষ বলে গণ্য নয়। সে বিবেক-বিবেচনাহীন ও একগুয়েমী স্বভাবের হয় বলে কেউ তাকে ভালবাসে না, শ্রদ্ধা করে না এবং তার প্রতি কারো কোনো আস্থা থাকে না।
তাই সে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নামের অযোগ্য বলে সে আল্লাহতায়ালার কাছেও অপছন্দনীয়। কাজেই সত্যিকার শিক্ষা বলতে যা বুঝায় তা একমাত্র ইসলামই প্রদান করেছে। সুশীল সমাজও শ্রেষ্ঠ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের বিকল্প আর কিছু নেই।
হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে শিশুর শিক্ষা শুরু হয় মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থায়।’ শিশু বিজ্ঞানীরাও একই মত পোষণ করেছেন।
এ সময়ে মায়ের আমল, চিন্তা-ভাবনা, ধর্মপরায়ণা ও সুষম খাদ্যগ্রহণ ইত্যাদি সব কিছুই গর্ভের সন্তানের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে এবং তা শিশুর সঠিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
তাই এ সময় মাতাকে বিশেষ সচেতন থাকতে হয় এবং নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। কারণ অসৎ আমল, কুচিন্তা, ধর্মহীনতা ও অসম খাদ্য গ্রহণ দ্বারা সুস্থ ও পবিত্র শিশু জন্মলাভ করতে পারে না।
রাসুল করিম (সা.) তাই বলেছেন, ‘সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই তার তরবিয়ত অর্থাৎ চরিত্র গঠন শুরু করা উচিত।’
জন্মের পর শিশুর শিক্ষা পরিবারের আওতাভুক্ত থাকে। পরিবার ও তার পারিপার্শিক অবস্থা ভাল হলে শিশুর শিক্ষাও সঠিক এবং সুন্দর হয়। এখানে শিশুর শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে পিতামাতার ভ‚মিকাই প্রধান।
আমরা যদি শৈশবেই শিশুকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় গড়ে তুলি তাহলে আমাদের সন্তান দেশ ও জাতির জন্য হবে একজন আলোকিত মানুষ।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পূর্বে গৃহের পরিবেশই হলো শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিশুর সত্যিকার স্তম্ভ গঠিত হয়।
পরিশেষে এটাই বলব- আমরা আমাদের সন্তানদেরকে শৈশব থেকে যে উত্তম শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলার কথা তা হয়তো আমরা করছি না। আমরা জাগতিকতার মোহে আসক্ত হয়ে সন্তানদেরকে সময় দেই না, তাদের সাথে হয়তো সারাদিনে একঘন্টাও সময় কাটাই না।
তারা কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে চলাফেরা করে তা নিয়েও আমরা কখনো ভাবিনা। সন্তানের প্রতি আমাদের উদাসিনতার ফলেই আদরের এই সন্তানটি একদিন একটি পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
তাই আসুন, শিশুকে উত্তম আদর্শে গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রত্যেক পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেই। আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদেরকে সময় দেই এবং উত্তমভাবে লালন পালন করি।