হজের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা ও সফর বা ভ্রমণ করা। পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করা। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ এই তিন মাস, বিশেষত জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিন। হজের নির্ধারিত স্থান হলো হারামাইন শরিফাইন। এ জন্যই হাজিকে হাজিউল হারামাইন বলা হয়ে থাকে। হজের বিশেষ স্থানগুলো হলো মক্কা শরিফে-কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা ইত্যাদি এবং মদিনা শরিফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা শরিফ জিয়ারত করা।
হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাল হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাই, অকুফে আরাফাহ, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, দম ও কোরবানি, হলক ও কছর এবং জিয়ারতে মদিনা-রওজাতুল রাসুল ইত্যাদি।
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। কোরআন শরিফে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর তরফ হতে সে সকল মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা-৩ আল–ইমরান; আয়াত: ৯৭)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ব্যতীত অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা হজ পালন করবেন, আল্লাহ তাআলা তাঁদের হজ কবুল করবেন এবং তাঁদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হজ মানুষকে নিষ্পাপে পরিণত করে, যেভাবে লোহার ওপর হতে মরিচা দূর করা হয়।’ (তিরমিজি)। যে ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে অথচ তিনি হজ আদায় করেন না, তঁার জন্য রয়েছে বিশেষ সাবধান বাণী। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ (ফরজ হওয়া সত্ত্বেও) তা আদায় না করে মারা যায়, তাকে বলে দাও সে ইহুদি হয়ে মরুক অথবা খ্রিষ্টান হয়ে।’ (মুসলিম)। হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে দেয়। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে, সে পূর্বেকার পাপ হতে এরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায় যেরূপ সে মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল।’ (বুখারি)।
যদি কারও হজের ইচ্ছা থাকে এবং যথাসময়ে যথাযথ আয়োজন করে থাকেন, কিন্তু জীবন সংকটাপন্ন হয় এমন কোনো বাধাবিপত্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি ইত্যাদির কারণে তা সম্পাদন করতে না পারেন; তবে তিনি গুনাহগার হবেন না; বরং বিশুদ্ধ নিয়তের কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে তিনি হাজি রূপেই গণ্য হবেন। এ অবস্থায় বদলি হজের ব্যবস্থা ও অসিয়ত করে যাওয়া বাঞ্ছনীয়।
জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সামর্থ্যবানদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হজ করা সুন্নাত। সুযোগ থাকলে বারবার বা প্রতিবছর হজ করাতে বাধা নেই। হাদিয়া বা অনুদানের টাকা দিয়ে হজ করলেও তা আদায় হবে। চাকরি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল হিসেবে কর্তব্য কাজের সুবাদে হজ করলেও তা আদায় হবে। এটি বদলি হজ না হলে নিজের ফরজ হজ আদায় হবে; ফরজ হজ পূর্বে আদায় করে থাকলে এটি নফল হবে। অথবা অন্য কারও বদলি হজের নিয়তে আদায় করলে তা–ও হবে। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী)।
হজ সম্পাদনে নিজে শারীরিকভাবে অক্ষম হলে অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করানো যায়। বদলি হজে যিনি হজ সম্পাদন করেন, যিনি অর্থায়ন করেন এবং যাঁর জন্য হজ করা হয়, সবাই পূর্ণ হজের সওয়াব লাভ করবেন। যাঁরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ আদায় করতে পারেননি, তাঁদের কর্তব্য হলো বদলি হজ করানোর জন্য অসিয়ত করে যাওয়া। অসিয়তকৃত বদলি হজ অসিয়তকারীর সম্পদ দ্বারা তা বণ্টনের পূর্বে প্রতিপালন করা বা সম্পাদন করানো ওয়ারিশদের জন্য ওয়াজিব। অসিয়ত না করে গেলেও কোনো ওয়ারিশ বা কেউ নিজ উদ্যোগে বা ব্যক্তিগতভাবে তা আদায় করতে বা করাতে পারবেন। এতেও মৃত ব্যক্তি দায়মুক্ত হবেন এবং বদলি হজ করনেওয়ালা, করানেওয়ালা ও আর্থিক সহযোগিতাকারী সবাই সওয়াবের অধিকারী হবেন।
জীবিত বা মৃত যেকোনো কারও বদলি হজ করানো যায়। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত–অপরিচিত যেকোনো কেউ যেকোনো কারও বদলি হজ করতে বা করাতে পারেন। বদলি হজ আদায় করতে বা করাতে যার জন্য বদলি হজ করা হবে বা করানো হবে, তার অনুমতি বা অবগতি প্রয়োজন নেই; তবে সম্ভবপর হলে তা উত্তম।
বদলি হজ সম্পাদনের আগে নিজের হজ আদায় করা শর্ত নয়; বরং নতুনদের দ্বারা বদলি হজ করালে তার নিষ্ঠা আন্তরিকতা, আবেগ ও অনুরাগ বেশি থাকে। তবে যঁার নিজের হজ অনাদায়ি রয়েছে, তিনি বদলি হজ করতে পারবেন না। বদলি হজ আত্মীয়–অনাত্মীয়, নারী-পুরুষ যেকোনো কেউ করতে পারেন। তবে বিজ্ঞ আলেম বা পরহেজগার লোক হলে উত্তম।