একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে কার, এ–বিষয়ক কোনো জরিপ কখনো হয়েছে কি? হলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নাম ওপরেই থাকবে। গত দেড় হাজার বছরে দেশ–বর্ণ–ধর্মনির্বিশেষে অজস্র সাহিত্যিক, সমাজনেতা, শিক্ষাবিদ, সমরবিদ, গবেষক, রাষ্ট্রনায়ক, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁকে নিয়ে বিপুল প্রশস্তি বর্ণনা করেছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ না করেও তাঁকে মহামানবের স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিশ্বের ঘোর দুর্দিনে তাঁর মতো নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একেবারে আটপৌরে জীবনীগ্রন্থ থেকে বিশেষায়িত গবেষণাগ্রন্থ লিখেছেন তাঁরা অসংখ্য। একটিই মানুষ, একটিই তাঁর জীবন, একটিই কাহিনি—সেই মক্কার কুরাইশ পরিবারে জন্ম, আল-আমিন উপাধি, সিরিয়ায় বাণিজ্য, হেরা পর্বতের ধ্যানমগ্নতা, মক্কার দাওয়াত, তায়েফের ক্ষত, মদিনায় হিজরত, বদরের যুদ্ধ, বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ঊর্ধ্বগমন, আবার মক্কায় ফেরা, বিদায় হজ। একই কথা বহুমুখে বহুজনে বহুশতাব্দী ধরে বাতাসে বাতাসে ফিরছে, তবু যেন অফুরান, যেন কিছু লেখা হলো আর অলিখিত রয়ে গেল ঢের, কিছু বলা হলো আর অনেক কিছুই হয়নি বলা।
জীবনী রচনার সূচনাপূর্ব: মহানবী (সা.)–কে জানার প্রথম উৎস হলো কোরআন। যেমন তাঁর সম্পর্কে তাঁর জীবনসঙ্গী আয়েশা (রা.)–এর কাছে জানতে চাওয়ার পর তিনি বলেছেন, কোরআনই তাঁর চরিত্র। (ইমাম বুখারি, আল আদাব আল মুফরাদ, হাদিস: ৩০৮)। কোরআনজুড়ে প্রসঙ্গক্রমে নবীজীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতির ছায়া পড়েছে। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, যুদ্ধের নানান অনুষঙ্গ, অথবা নবীর স্ত্রীর নির্দোষিতা ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে তখনকার ঘটনার আলোকে। কোরআনের প্রাচীন তাফসির ও কোরআন নাজিলের প্রেক্ষাপট–সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিস এবং হাদিসের বিচ্ছিন্ন সংকলনগুলোতে তাঁর জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা বিধৃত হয়েছে। সেকালে রচিত ইতিহাসের আধার ও উপাদানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নবীজীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ধারাবাহিক জীবনী রচনার উন্মেষ ঘটেছে তাঁর ইন্তেকালের অন্তত ৫০ বছর পরে। কেননা নবীজি তখন নিজেই তাঁদের সামনে ছিলেন। এমনকি দূরে বা কাছের যাঁরা তখনো দেখেননি তাঁকে, তাঁদেরও সবার যেন একবার অন্তত দেখার সুযোগ হয়ে যায়, তাই তিনি বহু আগেই বিদায় হজের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর তিরোধানের পর পরবর্তী প্রজন্মও সাহাবিদের এমন একটি বিরাট দলের সান্নিধ্য পেয়েছেন, যাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের সব ইবাদত ও কাজকর্ম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আদর্শ মেনে বাস্তবায়িত হতো। তারপর সময়ের দূরত্ব যত বাড়তে থাকে, নবীজি সম্পর্কে জানার কৌতূহল বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি কেমন ছিলেন—এই প্রশ্নের আধিক্য মহানবীর জীবনকাহিনি রচনার পথ উন্মুক্ত করে দেয়। প্রজন্মান্তরে মহানবীকে দেখা ও তাঁকে জানার প্রবল ইচ্ছার কথা কি তিনিও জানতেন? যেমন তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের পরে উম্মতের মধ্যে আমার প্রতি এতটা ভালোবাসাসম্পন্ন লোক আসবে, যারা তাদের সম্পদ-পরিজনের বিনিময়ে হলেও আমাকে দেখতে চাইবে।’ (মুসলিম, সহিহ, হাদিস: ২৮৩২)। তো জীবিত সাহাবিগণ নবীজির বিবরণ তুলে ধরা শুরু করলেন, কখনো সংক্ষেপে, কখনো সবিস্তারে, আবার কখনোবা আংশিক। এভাবেই একসময় ধারাবাহিক জীবনী সামনে চলে এল।