একাধিক বিকল্প সিদ্ধান্তের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সফলতার পূর্বশর্ত। মানুষের জীবনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিদ্ধান্তের আলোকেই সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল করলে অনেক সময় করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়। অনেকে পরিণতির কথা না ভেবে আবেগের বশে জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবন বিপন্ন করে ফেলে। জীবন অনেক মূল্যবান। জীবনকে মূল্যায়ন করতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে আবেগ ও প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে, পরিণতির কথা চিন্তা করা জরুরি। পাশাপাশি মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক—
কল্যাণকর কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ : ‘দ্বিন মানেই হলো নসিহত বা কল্যাণকামিতা।’ (মুসলিম, হাদিস : ২০৫)
কাজেই দ্বিনদার ব্যক্তিকে হতে হবে কল্যাণকর কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। যেমন—ধর্মীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়া, অন্যের প্রয়োজন পুরো করা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা না করা, জুলুম-অত্যাচার ও অনাচার পরিহার করা এবং সব কাজে সেবার মানসিকতা জাগ্রত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ভালো কাজের সিদ্ধান্ত নিলেই মহান আল্লাহ নেকি দান করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ ভালো-মন্দ চিহ্নিত করে রেখেছেন। যে ব্যক্তি ভালো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; কিন্তু তা করেনি, আল্লাহ তার জন্য একটি পূর্ণ নেকি লিখেন। আর যদি ভালো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে আল্লাহ তাকে এই একটি ভালো কাজের জন্য ১০ গুণ থেকে সাত শ গুণ, বরং বহুগুণ পর্যন্ত ভালো কাজ হিসেবে লিখেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬১২৬; মুসলিম, হাদিস : ৩৫৫)
অভিজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ : সবাই সব বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে পারে না। যারা যে বিষয়ে অভিজ্ঞ সে বিষয়ে তাদের পরামর্শ নিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বড়দের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভুলের সম্ভাবনা কমে যায় এবং সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সহজ হয়। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের জিজ্ঞেস করো।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ৪৩)
কষ্টদায়ক সিদ্ধান্ত পরিহার : অনেকে আবেগের তাড়নায় জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাতা-পিতাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে মাতা-পিতা ও সন্তানের মধ্যেকার সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার চেয়ে অধিক কল্যাণকামী অন্য কেউ হতে পারে না। কাজেই মাতা-পিতা কষ্ট পায়—এমন সিদ্ধান্ত পরিহার করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ মাতা-পিতার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি মাতা-পিতার অসন্তুষ্টির কারণে হয়ে থাকে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৮৯৯)
জীবন বিনাশী সিদ্ধান্ত পরিহার : মানুষের জীবন ও জীবনোপকরণের সব কিছুই মহান আল্লাহর দান। জীবনকে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছচারিতার কোনো অবকাশ নেই। জীবনকে আল্লাহর দেওয়া আমানত মনে করতে হবে। জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি হয়—এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না। তোমরা সৎকাজ করো, আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণ লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
সময়ের সিদ্ধান্ত সময়ে : সব কিছুতেই সময় ও সামর্থ্যের ব্যাপার থাকে। সময়ের কাজ সময়ে করলেই তা যথার্থ ও বরকতময় হয়। তা ছাড়া সামর্থ্য তো থাকতেই হবে। কাজেই যথাসময়ে এবং সামর্থ্য অর্জন করার পর কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘হে যুবকরা, তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কারণ বিয়ে দৃষ্টি আনত রাখতে ও লজ্জাস্থানের হিফাজতে অধিক কার্যকর। আর যে ব্যক্তি বিয়ে করতে সক্ষম নয় সে যেন রোজা রাখে। কারণ রোজা তার যৌনচাহিদা অবদমিত করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৭৭৮; মুসলিম, হাদিস : ৩৪৬৪)
আল্লাহর ওপর ভরসা : বুদ্ধি-পরামর্শ করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের জন্য মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে হবে। মহান আল্লাহই উত্তম কর্মসম্পাদনকারী। তিনি চাইলেই কর্মের বাস্তবায়ন হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ বলেন, ‘এবং কাজে-কর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো, অতঃপর তুমি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে; যারা ভরসা করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
ইসতিখারা : ইসতিখারা অর্থ—কল্যাণ কামনা করা। বৈধ কোনো কাজের ব্যাপারে মন স্থির করতে না পারলে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করে বিশেষ নিয়মে যে নফল নামাজ আদায় করা হয়, তাকে ইসতিখারার নামাজ বলা হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইঙ্গিত পাওয়ার জন্য ইসতিখারার নামাজ আদায় করা হয়। এরপর যেদিকে মনের ঝোঁক সৃষ্টি হয়, সেটিই মঙ্গলজনক বলে বিবেচিত হয়। কেউ স্বপ্নের মধ্যেও জেনে যেতে পারে। তবে স্বপ্নে দেখা জরুরি নয়। ইসতিখারার নামাজ প্রসঙ্গে হাদিসে বলা হয়েছে, জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোরআনের সুরা শেখানোর মতো ইসতিখারার নামাজ শেখাতেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজের ইচ্ছা করে, তখন যেন ফরজ ছাড়া দুই রাকাত নামাজ আদায় করে। অতঃপর নির্ধারিত দোয়া পাঠ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ১১০৯; আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৪০; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৮৩)
পরিশেষে বলা যায়, আবেগ বা গুজবের ওপর নির্ভর না করে; বরং বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে তা বাস্তবায়নে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। জীবন আল্লাহর দেওয়া বড় নিয়ামত। জীবনকে মূল্যায়ন করতে হবে। জীবন ঝুঁকিতে পড়ে—এমন সিদ্ধান্ত পরিহার করতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন।