মানবজাতির চরিত্র গঠনে কোরআন অনুপম একটি গ্রন্থ। যে ব্যক্তি যথাযথভাবে কোরআন তিলাওয়াত করবে, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং তা জীবনে বাস্তবায়ন করবে আল্লাহ তাকে সচ্চরিত্রের অধিকারী করবেন। বরং কোরআনই উত্তম চরিত্রের সর্বোত্তম মাপকাঠি। আয়েশা (রা.)-কে মহানবী (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘তাঁর চরিত্র ছিল কোরআন।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ৪৮৬২)
চরিত্র গঠনে কোরআন সর্বোত্তম অবলম্বন
মানব ইতিহাসে মানুষের হৃদয়ে ও জীবনযাপন সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী গ্রন্থ কোরআন। তাই কোরআন হতে পারে মানুষের চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম অবলম্বন। মানবহৃদয়ে কোরআনের প্রভাব সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণীসংবলিত কিতাব, যা সুসামঞ্জস্য এবং যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। এতে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ২৩)
কোরআন আলোর দিশারি
কোরআন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে সাদিতে বলা হয়েছে, জ্যোতি দ্বারা উদ্দেশ্য কোরআন। কেননা তার মাধ্যমে মূর্খ ও পথভ্রষ্টরা পথ লাভ করে। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি অবতীর্ণ করেছি কোরআন, যা মুমিনের জন্য আরোগ্য ও রহমত। কিন্তু তা অবিচারকারীর জন্য ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৮২)
উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘কোরআন মানুষের হৃদয়ের রোগগুলো দূর করে দেয়। যেমন সন্দেহ, নিফাক, শিরক, হৃদয়ের বক্রতা ইত্যাদি। আর কোরআনের মাধ্যমে ঈমান, প্রজ্ঞা, কল্যাণকামিতা ও কল্যাণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় তা মানবজাতির জন্য রহমত বা অনুগ্রহ।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)
কোরআন অনুশীলনকারী পথভ্রষ্ট হবে না
যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের (বিশ্বাস ও নিষ্ঠার) সঙ্গে কোরআন পাঠ করবে এবং তা অনুসরণ করবে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং দুঃখ-কষ্ট পাবে না।’ (সুরা তাহা, আয়াত : ১২৩)
ইমাম তাবারি (রহ.) উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বক্তব্য উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, ‘যে কোরআন পাঠ করে এবং তাতে যা আছে তার অনুসরণ করে, আল্লাহ তাকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবেন এবং সংরক্ষণ করবেন।’
কোরআনে চরিত্র গঠনের নির্দেশগুলো
পবিত্র কোরআনে মানুষকে মন্দ চরিত্র পরিহার ও সচ্চরিত্র গঠনের অসংখ্য নির্দেশ ও নির্দেশনা এসেছে। যার কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ক্ষমা ও সৎকাজের আদেশ : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদের এড়িয়ে চলো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৯৯)
রাগ দমন : অনিয়ন্ত্রিত রাগ মানুষকে অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা রাগ দমন করে এবং মানুষদের ক্ষমা করে, আল্লাহ অনুগ্রহশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪)
মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ : কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন) মা-বাবার সঙ্গে সদাচরণ করার এবং নিকটাত্মীয়, এতিম ও নিঃস্বদের প্রতিও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৩)
সুন্দরভাবে কথা বলা : কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মানুষের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলো, নামাজ আদায় করো এবং জাকাত দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৩)
পরস্পর সহযোগিতা : মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমরা নেক কাজ ও আল্লাহভীতিতে পরস্পরকে সহযোগিতা করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করো না।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২)
মানুষের অধিকার আদায় : মানুষের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানত তার অধিকারীর কাছে পৌঁছে দাও এবং তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করো তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে তা করো।’ (সুরা নিসা, আয়াত ৫৮)
সঠিক পরিমাপে পণ্য বিক্রি : আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা মাপে পূর্ণ মাত্রায় দেবে, যারা মাপে ঘাটতি করে তোমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সুরা শুআরা, আয়াত : ১৮১)
কোরআন পাঠে হৃদয় উন্মুক্ত হয়
কোরআন মানুষের হৃদয় প্রশস্ত করে এবং আল্লাহর সত্য দ্বিন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি তারা কোরআন সম্পর্কে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সুরা মুহাম্মদ, আয়াত : ২৪)
কোরআন দ্বারা উপকৃত হওয়ার শর্ত
কোরআন মানবজাতির জন্য আলোর দিশারি। তবে তা দ্বারা সবাই উপকৃত হতে পারে না, বরং তা কারো কারো দুর্ভাগ্যের কারণ হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ এর (কোরআনে বর্ণিত দৃষ্টান্ত) মাধ্যমে বহুজনকে পথভ্রষ্ট করেন এবং বহুজনকে পথপ্রদর্শন করেন। এর মাধ্যমে বস্তুত পাপীদের পথভ্রষ্ট করা হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬)
এ জন্য গবেষক আলেমরা বলেন, কোরআন দ্বারা উপকৃত হওয়ার শর্ত হলো—পবিত্র মন ও শরীর নিয়ে তা পাঠ করা, অর্থ-মর্ম উপলব্ধির চেষ্টা করা, মনোযোগসহ পাঠ করা এবং অন্তরে সুপথ লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) তাদের পথ দেখান, যারা তাঁর অভিমুখী।’ (সুরা রা’দ, আয়াত : ১৩)
আল্লাহ সবাইকে কোরআন দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।