অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই করোনা ভাইরাস ভ্যাক্সিন নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে হালাল সার্টিফিকেশন প্রদান করার দাবি জানাচ্ছে। বহু মুসলিম দেশই ভ্যাক্সিনটি হালাল কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নাগরিকদের ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা ভেবে দেশীয় বাজারে ভ্যাক্সিন ছাড়তে চাইছেন না।
হালাল ভ্যাক্সিন কী ?
কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের হালাল সার্টিফিকেশন হল, এই ভ্যাক্সিনে যে কোনও ধরনের ইসলাম-বিরোধী উপাদান নেই তার আইনসম্মত নথি। হালাল ভ্যাক্সিন সার্টিফিকেশন থাকলে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা নিশ্চিন্ত হতে পারবেন যে তাঁদের শরীরে কোনও রকম ইসলাম-বিরোধী বা হারাম পদার্থের প্রবেশ হচ্ছে, এবং তার ফলে তাঁরা নিশ্চিন্তে সেই ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন।
ভ্যাক্সিনেশান-বিরোধী কোনও আন্দোলনের জেরে কোনও ধরনের ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে শুরু করলে, তার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়। মূলত সেই কথা ভেবেই আগাম হালাল সার্টিফিকেশনের দাবি উঠছে।
বহু রাষ্ট্রপ্রধানই মনে করছেন, ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা ভেবে হালালের মতো ইস্যুকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং সাধারণ মানুষের কাছে আগে এই সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়া উচিত, যার ফলে মুসলিমরা নির্দ্বিধায় এই ভ্যাক্সিন গ্রহণ করতে পারবেন। এমনকী সম্প্রদায়ের অন্য মানুষদেরও উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন যাতে তাঁরা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী এই ভ্যাক্সিন গ্রহণ করতে এগিয়ে আসেন।
ইন্দোনেশিয়ার ঘোষণা
ইন্দোনেশিয়ার উলেমা কাউন্সিল হালাল প্রোডাক্ট গ্যারেন্টি এজেন্সি এবং ইনস্টিটিউট ফর দ্য অ্যাসেসমেন্ট অফ ফুড, ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিক্স দ্বারা পরিচালিত একটি সমীক্ষা সম্প্রতি শেষ হয়েছে এবং তা ফতোয়া ও হালাল সার্টিফিকেশন প্রদানকারী কাউন্সিলের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে বলে একটি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন সেই দেশের মানব উন্নয়ন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রী মুহাদজির এফেন্দি।
এ দেশের রাষ্ট্রপতি জোকো ইউডোডো তাঁর মন্ত্রীদের সাবধান করেছেন যেন, নোভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন বাজারে ছাড়ার বিষয়ে কোনও তাড়াহুড়ো করা না হয়। যত ক্ষণ না জানা যাচ্ছে যে এই ভ্যাক্সিন হালাল সার্টিফায়েড কি না, কিংবা ইসলাম-সম্মত কি না- ততদিন জনগণের ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা ভেবে এই ভ্যাক্সিন ইন্দোনেশিয়ার বাজারে ছাড়া হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি একটি বৈঠকে জোকো ইউডোডো বলেছেন, “সম্ভাব্য কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের হালাল স্ট্যাটাস সম্পর্কে আমাদের দেশের জনগণের যে স্বাভাবিক উৎকণ্ঠা রয়েছে, তাকে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিই।”
মালয়েশিয়ার ফার্মানিয়াগা
আর মুসলিমদের এই ধর্মীয় ভাবাবেগের কথা ভেবেই কোভিড-১৯ প্রতিরোধক হালাল ভ্যাক্সিন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে মালয়েশিয়ার একটি ফার্মাসিউটিকাল সংস্থা ফার্মানিয়াগা। এই সংস্থার দাবি ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রথম হালাল ভ্যাক্সিন নির্মাণ করে ফেলবে তারা।
হালাল ভ্যাক্সিন নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয় অবশ্য। কোনও রোগের ভ্যাক্সিন ইসলাম আইন মেনে তৈরি হয়েছে কি না, এই বিষয়ে আগেও ইন্দোনেশিয়ায় বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। যেমন- ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার উলেমা কাউন্সিল ফতোয়া জারি করেছিল, যে হামের ভ্যাক্সিন হারাম বা ইসলাম অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন হারাম নাকি হালাল, এই বিতর্ক প্রসঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি বলেছেন, “দেশের আমজনতাকে সবার আগে জানানো হবে ভ্যাক্সিনটি হালাল কি না, তার দাম ও মান কী রকম। তারপরে সেই ভ্যাক্সিন বণ্টন করার জন্য উপযুক্ত সুষ্ঠু পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।”
যদিও মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডিরেক্টর-জেনারেল নূর হিশাম আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, সেই দেশের নাগরিকদের প্রদান করার জন্য কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের হালাল হওয়া জরুরি নয়। এই ভ্যাক্সিনে ইসলামে নিষিদ্ধ কোনও উপাদান রয়েছে কি না, সেই বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকার চিন্তিত নয় বলেই জানিয়েছেন তিনি।
হালাল নির্ভর ওষুধ
নূর হিশাম বলেন, “যদি ভ্যাক্সিনের হালাল সার্টিফিকেশন পাওয়া যায় তাহলে খুবই ভালো, তবে কোনও ওষুধ হালাল নাকি হালাল নয়, তার উপরে নির্ভর করে সেই ওষুধ আমরা রেজিস্টার করি না। কার্যকারী প্রমাণ হলে আমরা হালাল নয় এমন ওষুধও রেজিস্টার করে থাকি।”
যদিও মালয়েশিয়ারই একটি ফার্মাসিউটিকাল সংস্থা ফার্মানিয়াগা অন্যান্য মুসলিম দেশগুলির ধর্মপ্রাণ মানুষদের কথা ভেবে হালাল ভ্যাক্সিন তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হালাল ভ্যাক্সিনের অপেক্ষায় রয়েছেন মালয়েশিয়ার বহু স্থানীয় মুসলিম। অনেকেই জানিয়েছেন, দেশের বাজারে করোনা ভ্যাক্সিন চলে এলেও তাঁরা হালাল ভ্যাক্সিন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
গত নভেম্বর মাসেই করোনা প্রতিষেধক ভ্যাক্সিন নির্মাণকারী অন্যতম সংস্থা ফাইজারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেখানে বলা হয়েছে এই সংস্থা মালয়েশিয়াকে ১২.৮ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাক্সিন সরবরাহ করবে। এর ফলে সেই দেশের ২০ শতাংশ নাগরিক উপকৃত হবেন। এর পাশাপাশি মালয়েশিয়ার সরকার কোভ্যাক্স ফেসিলিটির সাথেও চুক্তি করেছেন জনগণের জন্য আরও ১০ শতাংশ ভ্যাক্সিন সরবরাহ করার জন্য।
শুধু এই দুইটি সংস্থাই নয়, মালয়েশিয়ার সরকার চিনের কাছ থেকেও ভ্যাক্সিন কেনার চেষ্টা করছে। ফলে এই ভ্যাক্সিনগুলি আদৌ হালাল কি না, সেই বিষয় নিয়ে স্থানীয় মুসলিমরা যথেষ্ট চিন্তিত। যদিও সেই দেশের সরকার এই ধরনের বিষয়কে বিশেষ আমল দিচ্ছেন না।