হজ মহান আল্লা’তালার নৈকট্য ও বরকত প্রাপ্ত হওয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। এটি ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। সামর্থ্য রয়েছে এমন মুসলমানের উপর হজ ফরজ। সূরা আল ইমরানে আল্লাহ বলেন,
‘মক্কা শরিফ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর আল্লাহর জন্য হজ আদায় করা ফরজ’।
একজন সহি মুসলমান হিসাবে জীবনে অন্তত একবার প্রত্যেকরই হজ যাত্রা করা উচিত। হজ যাত্রা ও মক্কার ছবি ও ভিডিয়ো দেখলে একজন ইমানদার মুসলমানের গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। হজ যাত্রা কিন্তু মুখের কথা নয়। মনের ইচ্ছের সঙ্গে বিস্তর পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা যদি সত্যিই মহান আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হতে চাই তাহলে কঠিন থেকে কঠিনতম যাত্রাও আমাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। ইচ্ছেশক্তির এমনই ক্ষমতা!
অনেক মানুষ হজ যাত্রা শুরু করার কয়েক মাস বা কয়েক সপ্তাহ আগে পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। কিন্তু সাচ্চা মুসলমানের পরিকল্পনা তখন থেকেই শুরু করা উচিত যখন থেকে সে হজে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
হজের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেছেন,
‘আমি নবী করিম সাঃ কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিবেদিতভাবে, সর্বপ্রকার পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতামুক্ত হয়ে হজ আদায় করল, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরল।’ [বুখারি-১৫২১, মুসলিম-১৩৫০]
আপনার ভবিষ্যতের হজ যাত্রার পরিকল্পনায় সাহায্যের জন্য কিছু টিপস রইল এই প্রতিবেদনে। ইচ্ছেশক্তির সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা মিলে আপনার হজ যাত্রা হয়ে উঠুক সফল ও আনন্দময়।
১। লক্ষ্য বা ইরাদা স্থির করুনঃ
এটা অবশ্য কাউকেই বলে দিতে হয় না। হজ যাত্রার সূচনা হয় ইচ্ছে থেকে। সেই ইচ্ছে আস্তে আস্তে পরিণত হয় ইরাদায়। এই ইরাদা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ইরাদা যত দৃঢ় হবে তত হজে যাওয়ার গঠমূলক পরিকল্পনা আপনি করতে পারবেন। হজ যাত্রা পুণ্য সম্পূর্ণ ভাবে লাভ হবে এইভাবেই।
২। হজ যাত্রার জন্য অর্থ সঞ্চয় করুনঃ
ইরাদা পরিকল্পনার সঙ্গে হজ যাত্রার জন্য যে জিনিসটি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন তা হল অর্থ। মনে রাখবেন, হজ যাত্রা আপনার জীবনের অন্যতম ব্যয়বহুল যাত্রা হবে। সেই জন্য এখন থেকেই রিসার্চ করে একটি সেভিংস বানাতে শুরু করুন। এখন হজ যাত্রার জন্য নানাপ্রকার প্যাকেজ পাওয়া যায়। ইন্টারনেট সেই সমস্ত প্যাকেজ সম্পর্কে খোঁজ নিন। আপনার বাজেট ও জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে যে প্যাকেজ মিলে যাচ্ছে সেই প্যাকেজে নিজের নাম নথিভুক্ত করান। এই সমস্ত প্যাকেজের ফলে আপনি আপনার সঙ্গে যাওয়ার জন্য একটি দল পাবেন। তবে, আপনি যদি একা যেতে চান তার ব্যবস্থাও এই প্যাকেজ করে থাকে।
আরেকটি জিনিস মাথায় রাখতে হবে। হজ যাত্রার জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করছেন তা যেন ঋণ করে না হয়। উলটে, আপনার যদি কোনও ঋণ থাকে তাহলে অবশ্যই সেগুলো মিটিয়ে নেবেন। ঋণগ্রস্থ অবস্থায় হজে না যাওয়াই শ্রেয়।
হজ সেভিংস ফান্ড কিন্তু আপনি বাড়িতেই খুলতে পারেন। প্রতিদিনের খরচ থেকে অল্প অল্প করে টাকা সঞ্চয় করতে থাকলেই আপনি একদিন দেখবেন আপনার হজ যাত্রার ফান্ড সম্পূর্ণ তৈরি।
৩। যাত্রাপথে নানা অভিজ্ঞতার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হোন
হজ যাত্রা কিন্তু সাধারণ বেড়াতে যাওয়ার বিষয় নয়। হজ শব্দের অর্থ কোনো পবিত্র স্থান দর্শনের সংকল্প করা। আল্লাহ আলামিন ইরশাদ করেছেন,
‘আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন কর।’ [সুরা বাকারা- ১৯৬]
সুতরাং যাত্রাপথে নানাবিধ অভিজ্ঞতা হবেই। সেই সমস্ত কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্যে থেকে আপনাকে সদর্থক অভিজ্ঞতাটিকে গ্রহণ করতে হবে। হজ যাত্রা আসলে আল্লাহ কর্তৃক আমাদের শিক্ষাপ্রদান। এই শিক্ষা প্রতিমুহূর্তে মাথা পেতে নিতে হবে।
৪। মক্কা ও মদিনার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হোন
হজ যাত্রার আগে অবশ্যই কুরআন ও হাদিস সম্পূর্ন ভাবে পড়ে ফেলুন। কুরআনের প্রত্যেকটি সুরার অর্থ ও অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে অবগত হোন। মহান নবীর জীবনকাহিনী সম্পর্কে জানতে শুরু করুন। মক্কা কীভাবে গড়ে উঠেছিল, মদিনার ইতিহস কী? আমাদের কিবলার দিকনির্দেশনার কারণ কী? এইসব বিষয়ে জানলে আপনি যখন পবিত্র মক্কায় পা রাখবেন দেখবেন মন প্রজ্ঞানতার শান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
৫। উপাসনা বা সালাতের অর্থ জানুন
একজন সহি মুসলমান প্রাত্যহিক যে সালাহ পালন করে তা আসলে আল্লাহর সঙ্গে বার্তা বিনিময়। দিনে পাঁচ বার নমাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি। সালাত পালন করার সময় যা উচ্চারণ করছেন তার অর্থ বুঝুন। না বুঝে আল্লাহকে উপাসনা করার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বুঝে আল্লাহর উপাসনা করা। এর ফলে আল্লাহর সঙ্গে খুব সহজেই আপনি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন।
৬। উইল তৈরিতে হাত দিন
আগেকার দিনে বলা হত হজ যাত্রা করলে মহান আল্লাহর চরণেই ঠাঁই নেয় মানুষ। আসলে সেই সময় যাত্রাপথ এত দুর্গম ছিল যে অনেকেই যাত্রা শেষ করে ফিরে আসতে পারতেন না। বর্তমানে এতটা দুর্গম না হলেও হজ যাত্রা আসলে অনেকখানি সময়সাপেক্ষ। সেই জন্যই সহি মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে যাত্রা শুরুর আগে নিজের সম্পত্তির সঠিক বিলি ব্যবস্থা করে যেতে। যদি কোনও কারণে ফেরা না হয় তাহলে পরিবারের যেন অসুবিধা না হয়।
৭। যাত্রা শুরুর আগে পরিবার ও সঙ্গীদের সঙ্গে সমস্ত সমস্যা মিটিয়ে নিন
মানুষের সম্পর্কে বিচ্ছেদ ও মনোমালিন্য খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু হজ যাত্রার আগে এই সমস্ত বিষয় মিটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী রাসুল (সাঃ)। সমস্ত অশান্তি মনোমালিন্য মিটিয়ে নিয়ে তবেই যাত্রা শুরু করা সমীচীন। পারিবারিক অশান্তি বজায় রেখে হজ যাত্রা গুনাহ বলে ধরা হয়। মনে রাখবেন, নবী (সাঃ) পারিবারিক বন্ধনচ্ছিন্ন করাকে দোজখে যাওয়ার সমান বলে গণ্য করেছেন। আল্লাহর নবী (সাঃ ) বলেন,
‘মানবজাতি হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পরিবার আর তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর পছন্দনীয়, যারা তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে।’ [তাবরানি আওসাত, হাদিস : ৫৫৪১]
অতএব, হজ যাত্রার ইচ্ছে থাকলে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে দিন। মহান নবীর কথা অনুসারে,
‘একবার ওমরাহ আদায়ের পরে দ্বিতীয়বার যখন ওমরাহ আদায় করা হয়, তখন দুই ওমরাহর মধ্যবর্তী গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। আর হজে মাবরুর বা পুণ্যময় হজের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত’ [বুখারি-১৭৭৩; মুসলিম-১৩৪৯; তিরমিজি-৯৩৩; নাসায়ি-২৬২৯; ইবনে মাজাহ-২৮৮৮]