একসময় আরবির ছন্দে মন্ত্রমুগ্ধ ছিল প্রাচীন পৃথিবী। মুসলিম সভ্যতা যখন তার স্বর্ণযুগের শীর্ষে, তখন বিজ্ঞান, কবিতা, সাহিত্য, রাজ্যচালনা ও শিল্পের ভাষা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল আরবি ভাষাকেই। এই কারণেই অধিকাংশ গ্রীক, রোমান এবং বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যের অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকে আরবিতে অনুবাদ করার একটি বৃহত্তর কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। এর ফলে সমসাময়িক বিশ্বে আরবি ভাষার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল।
আট শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে একাদশ শতাব্দীর শেষ অবধি আরবি ছিল মানবজাতির অন্যতম বৈজ্ঞানিক, প্রগতিশীল ভাষা। আরবি ভাষায় অনুবাদ সংক্রান্ত কাজের মান এতই উন্নত ছিল যে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমের দেশগুলি গভীর জ্ঞানলাভের জন্য গ্রীক ভাষার পরিবর্তে আরবি ভাষার আশ্রয় নিত।
১৮ ডিসেম্বের ইউনেস্কোর বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে, আমরা কিছু বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই সেই সমস্ত ক্ষেত্রে যেখানে আরবি ভাষা মুসলিম সভ্যতায় স্বর্ণযুগের সময় সর্বজনীন ভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আরবির ছন্দে লেখা হয়েছিল সৃজনশীলতার ইতিহাস।
১. আরবি যখন বিজ্ঞানের ভাষা
এক হাজার বছরেরও আগে, ইউরোপে তখন মধ্যযুগ। পশ্চিমের জ্ঞানপিপাসু বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের ক্রমাগত অন্বেষণের ফলে ঘটে চলেছে নিত্যনতুন আবিষ্কার, উদ্ভাবন, গবেষণ।
এই প্রবণতা তখন তুঙ্গে যখন বিভিন্ন উদ্ভাবন, রচনা, সাহিত্য ইত্যাদির জনপ্রিয়তা উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল।
গ্রীক, রোম, চীন, পার্সিয়া, ভারত এবং আফ্রিকার মতো দূর-দূরান্তের দেশ থেকে প্রাচীন জ্ঞানসম্ভার আনিয়ে তা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়েছিল। আর এই কাজে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন বাগদাদের তৎকালীন শাসকরা।
ফলে আরব তখন এমন এক সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছিল যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তের সেরা বৈজ্ঞানিক কাজগুলির আরবি অনুবাদ মজুত ছিল। এই কারণে আরব হয়ে উঠেছিল বিদ্যানুরাগীদের পীঠস্থান। ইবন আল-হাইথাম, আল-সুফি, ইবন সিনা, আল-রাজী, আল-খাওয়ারিজমি, আল-কিন্দি, আল-জাহিজ, আল-মাহামিলিয়ার মতো বিখ্যাত পণ্ডিতরা আলোকিত করে রাখতেন এই সময়কে।
২. আরবি যখন তারার ভাষা
মুসলিম সভ্যতার আমলে বিজ্ঞানের যে শাখায় বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল তার মধ্যে একটি হল অ্যাস্ট্রোনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞান। এই আমলের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে, আমাদের ছায়াপথের বাইরেও তারামণ্ডল রয়েছে। চাঁদের গতির তৃতীয় বৈষম্যও এই সময়েই আবিষ্কৃত হয়েছিল।
এই সময়েই এমন কিছু যুগান্তকারী যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল, যা আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল।
টলেমি’র আলমাজেস্ট গ্রন্থটি আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল নবম শতাব্দীতে। সেখানে আরবিতে বিভিন্ন তারার যে নামকরণ করা হয়েছিল। এটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তার মধ্যে অনেকগুলি পরবর্তী কালে সেই তারার নাম হিসেবে ব্যবহার করা হত।
কালপুরুষ তারামণ্ডলের বর্ণনা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা আল-সুফির বইতে দেওয়া হয়েছে।
সেখানে কালপুরুষের হাতে অস্ত্রের পরিবর্তে সেই তারার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে পোশাকের লম্বা হাতা হিসেবে।
এই ধরনের পোশাক সাধারণত সেই আমলে মুসলমানরা পরতেন।
৩. আরবি যখন শিল্প ও সৌন্দর্যের ভাষা
যে সমস্ত ক্ষেত্রে মুসলিম সভ্যতার প্রতিভা গোটা বিশ্বে স্বীকৃত হয়েছে, তেমনই একটি ক্ষেত্র হল শিল্প। ইসলামী বিশ্বের শিল্পীরা তাঁদের অন্তরের বিশ্বাসকে বিমূর্ত আকারে প্রকাশ করার পন্থা আবিষ্কার করেছিলেন। তার ফলে সেই আমলে বহু অসাধারণ শিল্পকর্ম তৈরি হয়েছিল।
ক্যালিগ্রাফি হল ইসলামি সংস্কৃতির এক অমূল্য শিল্পসৃষ্টি, যার মাধ্যমে বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর লেখার স্টাইলের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় জ্যামিতিক ছন্দ।
অনেক সময় সাধারণ ভাবে লেখা হলেও তাকে আলাদা শৈল্পিক মাত্রা দেওয়া হয়।
বর্তমানে ইংরেজি বর্ণের ক্যালিগ্রাফি জনপ্রিয় হয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে এই শৈল্পিক লেখরীতির ধারা শুরু হয়েছিল আরবি ভাষাতেই।
৪. আরবির ছন্দে কবিতার ভাষা
আরব সংস্কৃতিতে কবিতা হল একটি দৃঢ় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে বৈজ্ঞানিক আন্দোলন জোরদার হওয়া সত্ত্বেও তা কলাবিভাগ এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে কোনও বিরোধ তৈরি করেনি।
সেই সময় বিভিন্ন বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণের পাশাপাশি আরবি কবিতার নতুন এক ধরনের ধারা বিকশিত হয়েছিল। আরবির ছন্দে লেখা হয়েছে অজস্র কবিতা।
বিখ্যাত চিকিৎসক ইবন সিনা এবং বিখ্যাত নাবিক ইবন মজিদের মতো বিদ্বানরা এই নতুন ধারার কবিতা রচনা করে তা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
৫. আরবির ছন্দে সাহিত্যের ভাষা
আরবরা দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের ভাষাকে মনের ভাবকে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করার একটি নিখুঁত উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করেছে। খোদ কুরআন এবং পরবর্তী কালে রচিত বহু সাহিত্য এই কথাকে ১৪০০ বছর ধরে আরবি ভাষা তার আভিজাত্য বজায় রেখেছে। আরবির ছন্দে লিখিত হয়েছে ইসলামী বিশ্বের সাহিত্য।
কবিতা ছাড়াও আব্বাসীয়দের অধীনে গদ্যের বিকাশও ঘটছিল। সেই সময়ে প্রখ্যাত গদ্য রচনাকার ছিলেন আল জাহিজ (অষ্টম / নবম শতাব্দীতে বাগদাদে থাকতেন)। তাঁর বই আল বুখারা’আ (বুক অফ দ্য মাইজার্স) তাঁকে বিখ্যাত করে তুলেছিল। এই বইয়ে তিনি মনোবিজ্ঞানের বহু বিষয়ের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ কিন্তু মজাদার ভাবে পরিবেশন করেছিলেন। এছাড়াও সেই সময়ে অগণিত অন্যান্য লেখক এবং কবিরা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এমন লেখক ও কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আল মুত্তনবী, আল মা’আরি, ইয়াকুত আল হামভি, বদি আল জামান আল হামাথানি, ইবন হাজিম আল আন্দালুসি, ইবন তুফাইল প্রমুখ।