সংস্কার মানে পুনর্গঠন ও মেরামত করা। একটা পুরাতন- বস্তু বা একটি ভবন জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে তার সংস্কারের প্রয়োজন আমরা সহজে বুঝি। মানুষ যে ঘর-ভবনে বসবাস করে সেটির সংস্কার যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ যে সমাজে বসবাস করে সেই সমাজেরও সংস্কার ততখানি গুরুত্বপূর্ণ। ভাঙা ঝুকিপূর্ণ পতনোন্মুখ ভবনে বসবাস করতে গিয়ে পরিবারসুদ্ধ মারা পড়তে পারে। ঠিক তেমনি যদি একটি সমাজ ব্যবস্থা ধ্বসে পড়ে, তাহলে তার নিচে চাপা পড়ে শেষ হয়ে যায় গোটা সমাজ। যখন মানব ও মানব-সমাজ পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, হানাহানি, রাহাজানি ও খুন-খারাবিতে ছেঁয়ে যায়, তখন সে সমাজে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব হয়। চারদিকে তখন হাহাকার পড়ে যায় একজন সমাজ সংস্কারকের। যিনি ধ্বংসের হাত থেকে মানুষকে, সমাজকে উদ্ধার করবেন। সংস্কারের অভাবে বিশ্ববাসী এমন ধ্বংসের মুখোমুখিই হয়েছিল। যেমন ইরশাদ হচ্ছে-‘তোমরা আগুনের কুয়ার পাড়ে উপনীত হয়েছিলে, উহা থেকে আল্লাহ তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩।’ ধ্বংস থেকে উদ্ধারকারী, নিমজ্জিতদের উত্তোলনকারী, আর্তচিৎকারকারীদের ত্রাণকারী, বিশ্বমানবের মুক্তির দূত ও রহমাতের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যিনি সংস্কার সাধন করে বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন শান্তিময় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তাঁর মদীনা প্রজাতন্ত্রে ছিল না কোন পুলিশ, কোন দারোগা, কোন আদালত, কোন হামলা মামলা। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে যুদ্ধবাজ, দাঙ্গাবাজ, ফেতনাবাজ, দুর্ধর্ষ মরুবাসী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিকট তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর কি ছিল এমন যাদুকরী সংস্কার, যার বদৌলতে ও রকম একটি সমাজ আবার বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিময় সমাজে পরিণত হয়েছিল! আজ এই চরম অবক্ষয়ের যুগে নতুন করে সেই পয়গাম পৃথিবীবাসীর নিকট পৌঁছানো প্রয়োজন। তিনি প্রথমেই আহŸান জানালেন মিথ্যাকে পরিত্যাগ করো। মিথ্যা এমন পাপ যা মুখে উচ্চারণ করলে দুর্গন্ধে ফিরেশতারা এক মাইল দূরে গিয়ে অবস্থান নেয়। আর সবচেয়ে বড়ো মিথ্যা আল্লাহকে অস্বীকার করা। ইরশাদ হচ্ছে-‘তার চেয়ে আর কে অধিক জালেম হতে পারে, যে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করে অথবা সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে যখন তার কাছে আসে। নিশ্চয়ই জাহান্নাম কাফিরদের অবস্থান স্থল। সুরা আনকাবুত, আয়াত ৬৮।’ আল কুরআনের ১৪ টি আয়াতে এই একই কথা বলা হয়েছে।
এর মাধ্যমে তিনি মানুষকে উৎসাহিত করলেন সত্যকে গ্রহণ করে নিতে। ধীরে ধীরে মানুষ শান্তির বাণী কালেমা পড়ে ইসলামের শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। এতে হয়ে গেল হৃদয় বা আত্মার সংস্কার। যেখানে ছিল কুফরী আর শিরকের ময়লা। সকল ধর্মেই শয়তানকে মানবের চিরশত্রæ বলে হুশিয়ার করা হয়েছে। আর নবী করীম স. মানুষের মনের জগত হতে শয়তানের শয়তানিকে উৎখাত করে দিলেন। এখন আর কেউ কাউকে আঘাত করে না, হত্যা করে না। সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি মহান আল্লাহর নিকট হতে সফল কতিপয় নির্দেশনা পেলেন। সেগুলো একটি একটি বাস্তবায়ন করে সমাজকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র ও শান্তিময় করে গড়ে তুললেন।
তিনি কায়েম করলেন ন্যায় বিচার। একবার চুরির দায়ে মাখযুমিয়্যা গোত্রের এক মহিলার হাত কাটার হুকুম দিলে গোত্রের নেতৃবৃন্দ নবীজীর কাছে তা উড্ড করার সুপারিশ নিয়ে একজনকে প্রেরণ করে। তখন তিনি বললেন-‘যদি মুহাম্মাদের স. কন্যা ফাতিমাও চুরি করতো, আমি তাঁর হাতও কেটে দিতাম। বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৩৪৭৫।’
সংস্কারক অভিধাটির কেবল তিনিই বৈধ হকদার। মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে হত্যার বিচার নিশ্চিত করা দরকার। এ জন্যে তিনি কিসাস বা হত্যার বদলে হত্যা এ বিধান যখন চালু করলেন, দেখা গেল এখন আর কেউ কাউকে হত্যা করে না। কারণ নিজে সম্পূর্ণ নিরাপদে থাকতে পারবে, এমন গ্যারান্টির কথা ভেবেই তো অন্যকে হত্যা করে। কিসাসের মাধ্যমে হত্যার চিন্তাটাই মানুষের মাথা থেকে উড়িয়ে দেয়া হল। সবাই এবার জীবনের নিরাপত্তা পেল। বিজ্ঞানময় আল্লাহ আল কুরআনে সেকথাই ঘোষণা করেন-‘হে বোধ-সম্পন্নরা, কিসাসের মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে। এতে তোমরা হত্যা হতে বিরত থাকবে।’
অভাবীদের দান সদকা ও যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করলেন। এখন আর কেউ ক্ষুধায় কষ্ট পায় না। তিনি ঘোষণা করলেন-যে পেট পুরে খায়, অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত, সে মুমিন নয়। এমন ঘোষণায় নিজের ঈমান বাঁচানোর তাকিদেই সবাই ক্ষুধার্ত অভাবীদের খোঁজ নেয়া শুরু করলো। গঠিত হল ক্ষুধামুক্ত মদিনা রাষ্ট্র। এখানে ভাববার বিষয়, মানুষ যদি অভাবে থাকে, ক্ষুধার্ত থাকে কেউ যদি তার খোঁজনা নেয়, তাহলে অভাবে তো স্বভাব নষ্ট হবেই। আর মানুষের যদি স্বভাব নষ্ট হয়, তাহলে সমাজও নষ্ট হয়ে যাবে। কেননা, মানুষের সংঘবদ্ধ পরিবেশের নামই তো সমাজ।
তাই সমাজ সংস্কার বলতে ভৌত অবকাঠামোকে বুঝায় না। সেটার নাম উন্নয়ন। আর মানুষের স্বভাব চরিত্রের উন্নয়নের দ্বারা হয় সামাজিক উন্নয়ন। এটা নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাড়ে হাড়ে যেমন উপলব্ধি করেছিলেন, তেমন বাস্তবায়ন করেও দেখিয়ে ছিলেন। সকল প্রকার অন্যায়, অনাচার ও পঙ্কিলতা মুছে ফেলে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে তিনি পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করেছিলেন। আর এটা কেবল মাত্র তখিনই সম্ভব, যখন ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের কল্যাণেই সমাজ সংস্কার শুরু করা। তিনি তাই করেছিলেন। বুখারী শরীফের ৬৩৪৭ নং হাদীসে উল্লেখ-‘প্রিয়নবী স. নিজের উপর আরোপিত বিষয়ের কারণে কখনো কারো থেকে প্রতিশোধ নেননি, কেবল আল্লাহর হুরমাত বিনষ্টের কারণেই তিনি প্রতিশোধ নিতেন।’ আর এই একটি বিষয়েই নবীজীর সমাজ সংস্কার ও সমাজ সেবার সাথে আমাদেরটা পার্থক্য হয়ে যায়। আমরা প্রতিশোধ নেই নিজের বেলায়। নবীজী প্রতিশোধ নিতেন আল্লার বেলায়। আমরা অপরাধীদের প্রতি জিরো টলারেন্স ঘোষণা করি মুখে। আর নবীজী মুখে ঘোষণা না করে কাজে বাস্তবায়ন করতেন। আমরা মুখে বলি কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে কেউ পার পাবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। আর নবীজী এসব কথা মুখে না বলে অপরাধীকে ধরে ধরে আল্লাহর হুকুম মত বিচার কায়েম করতেন। অপরাধীরাও স্বেচ্ছায় এসে বিচার কায়েম করার জন্য হাজির হতেন। তাই আমাদের এই সমাজে বসবাস করতে হলে অবশ্যই এর সংস্কার করতে হবে। না হয় কেউ এখানে নিরাপদ নয়। আর সেই সংস্কারটা হতে হবে নূর নবীজীর রোডম্যাপ অনুযায়ী। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের কল্যাণার্থেই সমাজ সংস্কারে অংশ গ্রহণের তাওফিক দান করুন।