মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সুরে কোরআন তেলওয়াত করা হয়। এক সময় মধ্যপ্রাচ্যের সুরেলা কণ্ঠের কোরআন তেলওয়াত বিখ্যাত থাকলেও বর্তমানে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে আফ্রিকান অঞ্চলের তেলওয়াত। তেমনি এক জনপ্রিয় কোরআন তেলওয়াতকারী ছিলেন সুদানের ক্বারি নূরীন মোহামেদ সিদ্দিগ।
সম্প্রতি সুদানের এই ক্বারিকে নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনে বলা হয় নূরীন মোহামেদ সিদ্দিগ যখন কোরআন তেলাওয়াত করতেন সারা বিশ্বের মানুষ তার কণ্ঠে তখন খুঁজে পেতেন বিষাদ, হৃদয় স্পর্শ করা আবেগ এবং সুরের অপূর্ব মূর্ছনা। তার অনন্য কণ্ঠস্বর তাকে মুসলিম বিশ্বের জনপ্রিয় সব ক্বারিদের একজনে পরিণত করেছিল।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে সুদানে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ৩৮ বছর বয়সী নূরীন মোহামেদ সিদ্দিগ মারা যান। তার মৃত্যুতে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবখানেই ছড়িয়ে পড়েছিল শোক।
তার মৃত্যুতে টেক্সাসের ইমাম ওমর সোলেইমান টুইট করে লিখেছিলেন, বিশ্ব আমাদের সময়ের সবচেয়ে সুন্দর কণ্ঠগুলোর একটিকে হারালো।
বিভিন্ন ধর্মের বিষয়ে পড়ান এরকম একজন সুদানি-আমেরিকান শিক্ষক হিন্ড মাক্কি বলেন, তার গুণ ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন। লোকজন বলে যে তার কণ্ঠে আফ্রিকার আসল পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা আসলে কী তা তারা পরিষ্কার করে বলতে পারে না এবং তারা সেটা পছন্দ করে।
ইতিহাসবিদ সিলভেইন দিওফের মতে পশ্চিম আফ্রিকার দাস মুসলিমদের প্রার্থনা এবং তেলাওয়াতের সঙ্গে সাহেল অঞ্চল থেকে শুরু করে সুদান এবং সোমালিয়ার মুসলিমদের তেলাওয়াতের মিল রয়েছে। সেখান থেকেই হয়তো বিশেষ এই আফ্রিকান আমেরিকান সঙ্গীতের জন্ম হয়েছে যা পরে ব্লুজ সঙ্গীতে রূপ নিয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা হয় সুরেলা কন্ঠে। বলা হয় ইসলামের নবী এভাবে কোরআন পাঠ করার জন্য উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছিলেন, মানুষের কণ্ঠেই কোরআনের সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরেও এই বিশাল মুসলিম বিশ্বের ভৌগলিক অবস্থান, সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা অনুসারে এই তেলাওয়াতের ভিন্নতা থাকে। সেই ভিন্নতা স্বরে, সুরে ও ধরনে।
সুদানের ক্বারি নূরীন মোহামেদ সিদ্দিগ গত শতাব্দীতে নব্বই-এর দশকে রাজধানী খার্তুমের পশ্চিমে আল-ফারাজাব গ্রামের একটি মাদ্রাসায় কোরআন তেলাওয়াত শুরু করেন। পরে যখন খার্তুমে চলে আসেন, শহরের কয়েকটি বড় বড় মসজিদের নামাজে তিনি ইমামতি করেছেন এবং সেসময় তিনি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইউটিউবে তার একটি ভিডিও আপলোড করার পর তার নাম দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
কানাডায় আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিষয়ক অধ্যাপক মাইকেল ফ্রিশকফের বলেন, মিশরে পেন্টাটনিক কিম্বা ছয় নোটের হেক্সাটনিক সুরে কোরআন তেলাওয়াত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেটা আপনি পাবেন নিজের, সুদান, গানা এবং গাম্বিয়া এই দেশগুলোতে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে ইসলামিক সেন্টার অলিম্পিয়ার ইমাম ওমর জাব্বি সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার জন্ম সিয়েরা লিওনে। সেনেগাল এবং গাম্বিয়াতে শিক্ষকদের কাছে তিনি কোরআন তেলাওয়াত শিখেছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের নিজেস্ব সুরে কোরআন তেলাওয়াত আফ্রিকাসহ সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষ করে শহুরে এলাকায় যেখানে লোকজন ভিনাইল রেকর্ড, শর্টওয়েভ রেডিও, অডিও ক্যাসেট টেপ এবং সিডিতে কোরআন তেলাওয়াত শুনে থাকে। এগুলোর বেশিরভাগই উৎপাদন করা হয় মিশর ও সৌদি আরবে।
মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ও সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের দেশে ফিরে যান তাদের কারণে মধ্যপ্রাচ্য স্টাইলে কোরআন তেলাওয়াত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তার সঙ্গে রয়েছে উপসাগরীয় দেশগুলো অর্থ সহায়তায় গড়ে ওঠা বেশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। কিন্তু ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়ার কারণে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সুরেও এখন মানুষের নজরে পড়ছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে।
খার্তুমে একটি মিডিয়া কোম্পানি নাকা স্টুডিওর এলেবিদ এলসহাইফা বলেন, সোশাল মিডিয়াতে খরচ কম, সেখানে আইনি বিধি-নিষেধও কম। একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যা কিছু প্রয়োজন সোশাল মিডিয়ার সেসবের প্রয়োজন নেই।
আহমেদ আবদেলগাদের ২০১৭ সাল থেকে তার ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ইমাম জাব্বির তেলাওয়াত ভিডিওতে রেকর্ড করছেন। তিনি বলেন, “সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে আফ্রিকান সুরে করা একটি দোয়া যা ইতোমধ্যে কুড়ি লাখের বেশি দেখা হয়েছে। যারা এসব দেখেন তাদের বেশিরভাগই ফ্রান্সের, তারপরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এসব অনলাইন রেকর্ডের কারণে কোরআন পাঠ করার বিভিন্ন ধরনও সামনে চলে এসেছে। তার মধ্যে রয়েছে কোন শব্দ ঠিক কীভাবে উচ্চারণ করা হবে। এবিষয়ে রয়েছে সাতটি ধারা। এসব ধারার উচ্চারণে সামান্য পার্থক্য রয়েছে।
এসবের মধ্যে আজকের দিনে সবচেয়ে পরিচিত ধারাটি হচ্ছে হাফস। অটোমান তুর্কীদের শাসনামলে এই ধারাটি অনুমোদিত হয়েছিল। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব কোরআন পড়ানো হতো সেগুলো ছিল কায়রো ও মক্কায় প্রকাশিত।
তবে এর বাইরেও মুসলিম বিশ্বের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের গ্রামীণ এলাকায় কোরআন পাঠের বিষয়ে আরো কিছু ধারা প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সুদানের আল-দুরি। কোরআন তেলাওয়াতের সময় সিদ্দিগ বেশিরভাগ সময় এই ধারা অনুসরণ করতেন। তার তেলাওয়াতের স্টাইলের মধ্যে ছিল বিশ্বজনীন এবং একই সাথে বিভিন্ন আঞ্চলিক ঐতিহ্যের বিষয়।