পবিত্র কোরআনে শিক্ষা বিষয়ক শব্দগুলো পর্যালোচনা করলে সাধারণ শিক্ষা ও উচ্চতর শিক্ষা বোঝায়—এমন উভয় প্রকার শব্দ পাওয়া যায়। কোরআনে ব্যবহৃত ‘তা’লামুনা’ (শিক্ষাগ্রহণ), ‘তাজাক্কারুনা’ (উপদেশগ্রহণ), ‘আহাজ-জিকরি’ (জ্ঞানী) প্রভৃতি শব্দ থেকে যেমন সাধারণ শিক্ষার ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি ‘রাসিখুনা ফিল ইলম’ (গভীর জ্ঞানের অধিকারী), ‘উলুলুল আলবাব’ (প্রজ্ঞাবান), ‘এতাফাক্কাহুনা’ (গভীর জ্ঞানার্জন), ‘হিকমাহ’ (প্রজ্ঞা) ইত্যাদি শব্দ থেকে গভীরতম জ্ঞানের ধারণা পাওয়া যায়। কোরআনে উভয় শ্রেণির জন্য মর্যাদা ও বিশেষ মর্যাদা ঘোষিত হয়েছে। ইলম বা জ্ঞান সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে? জ্ঞানীরাই শিক্ষাগ্রহণ করে।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৯)
হিকমা বা প্রজ্ঞা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন। যাকে প্রজ্ঞা দেওয়া হয়, তাকে প্রভুত কল্যাণ দান করা হয়। কেবল জ্ঞানীরাই শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
উচ্চতর পাঠের বিধান
দৈনন্দিন জীবনে ইসলামী শরিয়ত পরিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ। আর দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন হয় না—এমন ধর্মীয় জ্ঞান—যাকে উচ্চতর ইসলামী পাঠ বলা যায় তা অর্জন করা মুসলিম উম্মাহর ওপর সামগ্রিকভাবে ফরজ। উম্মাহর একটি দল তাতে আত্মনিয়োগ করলে অন্যরা দায়মুক্ত হয়ে যাবে। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দ্বিনি জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরজ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২৪)
উচ্চতর পাঠের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেন তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ বের হয় না, যাতে তারা দ্বিন সম্পর্কে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে যখন তারা তাদের কাছে ফিরে আসে।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ১২২)
এ আয়াতের ব্যাখ্যা আল্লামা ইমাম তাবারি (রহ.) লিখেছেন, ‘আয়াতটি কোরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান অর্জন করা ফরজ করে; তবে তা সামগ্রিকভাবে উম্মতের জন্য, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নয়। আর আল্লাহর বাণী ‘তোমরা জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করো যদি তোমরা না জানো’ তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক জ্ঞান রাখে না। (তাফসিরে তাবারি)
উচ্চতর পাঠে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান
ইসলামী শিক্ষার ঊষাকালে ‘দারুল আরকাম’ ও ‘সুফফা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিকতার ধারণা পাওয়া যায়, তেমন শিক্ষার সামগ্রিক কার্যক্রম মহানবী (সা.) কেন্দ্রিক হওয়ায় ব্যক্তি নির্ভরতার প্রমাণও পাওয়া যায়। তবে মুসলিম গবেষকরা উচ্চতর পাঠের জন্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির সাহচার্য, গভীর অধ্যয়ন ও প্রায়োগিক চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আল্লামা ইবনে আবিদিন শামি (রহ.) ইলমে ফিকহ বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান লাভ এবং ফাতাওয়া প্রদানের জন্য একজন অভিজ্ঞ মুফতির অধীনে দীর্ঘদিন ফাতাওয়া চর্চার কথা বলেছেন। (শরহু উকুদি রাসমিল মুফতি, পৃষ্ঠা ৪০)
উচ্চতর ইসলামী পাঠের চার স্তম্ভ
সময়ের গবেষক আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক উচ্চতর ইসলামী পাঠের চারটি স্তম্ভ উল্লেখ করেছেন। তা হলো—এক. আহলে দিল তথা বিশুদ্ধ চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসের অধিকারী আলেমের সাহচার্য লাভ, দুই. আহলে ফন তথা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে পাঠ গ্রহণ, তিন. গভীর অধ্যয়ন ও অধ্যবসায়, চার. অর্জিত জ্ঞান আত্মস্থ করা।
(https://bit.ly/34DkvLd)
অর্থাৎ উচ্চতর ইসলামী পাঠে আগ্রহী শিক্ষার্থী একজন বিশুদ্ধ ও চিন্তার অধিকারী প্রাজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে জ্ঞানচর্চা করবেন এবং তার জ্ঞানচর্চায় থাকবে গভীরতা ও তা আত্মস্থ করার দৃঢ় প্রত্যয়।
চার স্তম্ভ রক্ষা না করলে যে ক্ষতি
বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও চিন্তার অধিকারী ব্যক্তির ছায়া গ্রহণ না করলে শিক্ষার্থী ইসলামী জ্ঞান, বিশ্বাস ও জীবন সম্পর্কে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা বহু বিকৃত চিন্তার অধিকারী যারা নানা স্বার্থে ইসলামী জ্ঞানের চর্চা করেছেন তারা মূলত দ্বিন ও ইসলামী শরিয়তকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। বিশেষত প্রাচ্যবিদ দ্বারা প্রভাবিত ও তাদের উৎস থেকে ইসলামী জ্ঞানচর্চাকারীরা কখনোই ইসলামের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারেনি; বরং তারা মুসলিম সমাজে নানাবিদ সংকট তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এ জন্য পূর্ববর্তী আলেমরা জ্ঞানচর্চায় ‘সনদ’ বা পরম্পরা রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই এ জ্ঞান দ্বিনের অংশ। সুতরাং কার কাছ থেকে তোমরা তোমাদের দ্বিন গ্রহণ করছ তা লক্ষ্য রাখো।’ (আল কামিল : ১/২৫৪)
অন্যদিকে উচ্চতর পাঠের জন্য প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তির সহযোগিতা গ্রহণ, গভীর অধ্যয়ন ও আত্মস্থকরণের প্রয়োজনীয়তা যে কেউ স্বীকার করবে।
ইসলামী পাঠে ভারসাম্য রক্ষা অপরিহার্য
উচ্চতর ইসলামী পাঠে ভারসাম্য রক্ষায় ‘মুখতালাফ ফি’ তথা মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে এবং ‘মুজতাহাদ ফি’ তথা যে বিষয়ে ইজতিহাদ করা হয়েছে এবং যেখানে গবেষণার অবকাশ রয়েছে বলে পূর্ববর্তী ইমামরা একমত হয়েছে, সেসব বিষয়ে একপেশে পাঠ পরিহার করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা শুধু নিজের অনুসৃত মাজহাব ও মতবাদের পাঠ নিলেও উচ্চতর স্তরে এসে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই তার পাঠের পরিধি বিস্তৃত করবেন এবং সব ইমাম ও মুজতাহিদের (মুসলিম গবেষক) মতামত ও প্রমাণাদি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করবেন। কেননা তারা যদি অন্যান্য ইমামদের মত ও দলিলাদি পাঠ না করেন তবে তাদের ভেতর সংকীর্ণতা, প্রান্তিকতা ও ভারসাম্যহীনতা তৈরি করবে। একতরফা পাঠ কখনো কখনো ব্যক্তিকে অন্যায় পক্ষপাতের শিকারেও পরিণত করে।
উচ্চতর পাঠগ্রহণকারীর অপরিহার্য কিছু বৈশিষ্ট্য
মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেকের বক্তব্যে উচ্চতর পাঠগ্রহণকারীর জন্য অপরিহার্য কিছু গুণ ও বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। তা হলো—
১. রুসুখ ফিদ-দিন : ইসলামী জ্ঞানের গভীরতা অর্জন করা। অল্প পাঠে তুষ্ট না হওয়া।
২. তাফাক্কুহ ফিদ-দিন : ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্ব অর্জন করা। গভীর উপলব্ধির মাধ্যমে দ্বিনের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং ইসলামী শরিয়তের মূলনীতিগুলো আত্মস্থ করা।
৩. ইতিদাল : তথা জ্ঞানচর্চায় ভারসাম্য রক্ষা করা। একপেশে ও পক্ষপাত মূলত জ্ঞানচর্চা পরিহার করা।
৪. ইকতিসাদ : মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। ইসলাম ও ইসলামী শরিয়তের যেকোনো বিষয়ে চরম বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্যের বিপরীতে মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা।
৫. তাকওয়া : আল্লাহভীতি অর্জন করা। ইসলামী জ্ঞানচর্চাকারী নিজের অন্য সব বিষয়ের মতো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি ভয় করবে এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনকে চূড়ান্ত লক্ষ্য বানাবে।
৬. তাহারাত : উচ্চতর ইসলামী জ্ঞানের ধারক অবশ্যই বিশ্বাস, চিন্তা, চেতনা ও মননে পবিত্র হবেন এবং তিনি আত্মিক ও বাহ্যিক উভয় বিবেচনায় পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবেন। (প্রাগুক্ত)
আল্লাহ সবাইকে যথাযথভাবে জ্ঞানার্জনের তাওফিক দিন। আমিন।