আংশিক স্মৃতিকথা এবং আংশিক ভ্রমণগাঁথা, মুহাম্মদ আসাদের “দ্য রোড টু মক্কা” মধ্য প্রাচ্য সম্পর্কিত বইগুলির মধ্যে একটি উজ্জ্বল রত্ন। এই বইয়ের প্রেক্ষাপটে রয়েছে উসমানীয় খিলাফতের পতনের ঠিক আগেকার সময় – অর্থাৎ এমন সময়কালের কথা যে সময় নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়নি। তাই এটি হল এক অপরিহার্য ঐতিহাসিক ভূমির ঐতিহাসিক কথা।
১৯৫৪ সালে আমেরিকাতে একটি ব্যতিক্রমী বইটি উপস্থিত হয়েছিল যা দ্রুত পর্যালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর পৃষ্ঠাগুলির মধ্যে রয়েছে এক অতি স্পষ্ট বক্তব্য এবং এমন এক পৃথিবীর বিবরণ যা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল; প্রকৃতপক্ষে, আজ মনে হচ্ছে যে যুগের কথা এই বইয়ে বলা হয়েছে তা আরবের বালির ঢেউয়ে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।
বইটি একজন ভিতরের লোকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আরবীয় জীবনের সারমর্ম এখানে তুলে ধরেছে, এই বিষয়টিকে এখানে এত ভালো ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, এ কথা মনে রাখা এক এক সময় খুবই কঠিন হয়ে পড়ে যে, আসাদ এখানে যে ব্যক্তির অবস্থান থেকে সমগ্র বর্ণনা তুলে ধরেছেন, তিনি হলেন একজন অমুসলমান পর্যটক যাঁর দেশ হল ইউরোপের মাটিতে।
বইটির একটি অংশের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হল
আমরা চড়তে থাকি, আমরা দু’জন মানুষ আরবের উটের পিঠে চড়তে থাকি আমাদের মাথার উপরে সূর্যের শিখা, সবকিছুই ঝকঝকে এবং উজ্জ্বল এবং আলোর মধ্যে সাঁতার কাটছে। লালচে এবং কমলা রঙের টিলা, টিলাগুলির বাইরে টিলাগুলির পিছনে টিলা, একাকীত্ব এবং জ্বলন্ত নীরবতা এবং সেই ঝুলন্ত গেটে দুটি আরবের উটের পিঠে চড়তে থাকা দুটি লোক যা আপনাকে নিদ্রাতুর করে তোলে, যাতে আপনি দিন, সূর্য, উত্তপ্ত বাতাস এবং এই দীর্ঘ পথ ভুলে যান । টিলার উপরে বিক্ষিপ্ত ভাবে গজিয়ে ওঠা হলুদ ঘাসের গুচ্ছ, এবং এখানে এবং সেখানে হামধের ঝোপঝাড়গুলি হাওয়ার সাথে দানবীয় সাপের মতো ছড়িয়ে পড়ে। নিদ্রাতুর হয়ে উঠেছে ইন্দ্রিয়, আপনি জিনে দোল খাচ্ছেন, উটের পায়ের নিচে বালুকণার বাইরে আপনার অন্য কিছু বোঝার ক্ষমতা খুবই কম…
দ্য রোড টু মক্কা বইটি কেন ব্যতিক্রমী?
এখানেই হল, “দ্য রোড টু মক্কা” গল্পের সার্থকতা কারণ এখানে একজন ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের ধীরে ধীরে ইসলামের প্রতি অনুগত হয়ে ওঠার এক অসাধারণ গল্প। তাঁর মক্কায় যাত্রার (তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে) সময় বারবার তাঁর পূর্বতন আরব সফরের স্মৃতি ঠিক যেন ফ্ল্যাশব্যাকের মতো উঠে এসেছে, যে সময় তিনি বাস্তবে একজন অমুসলিম ছিলেন। “দ্য রোড টু মক্কার” এই অনুষঙ্গ এটিকে জীবনীর চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে কারণ এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মানুষের আধ্যাত্মিক আবিষ্কারের অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরা হয়েছে। এবং এখানেই শেষ নয়। “দ্য রোড টু মক্কা” বইটিতে মধ্য প্রাচ্যে গত শতাব্দীর বিংশ ও ত্রিশের দশকের রাজনৈতিক বাস্তব ছবির এমন প্রাঞ্জল এবং সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ রয়েছে যে এটি যে কোনও রাজনৈতিক ইতিহাসবিদের কাছে রত্নখনির মতোই আকর্ষণীয়। ইতালীয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় প্রতিরোধের সাথে তাঁর জড়িত হওয়া এবং ওমর মুখতারের সাথে তাঁর সাক্ষাতের বিবরণ এই বইটি মুগ্ধ হয়ে পড়ার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ অবশ্যই।
রুক্ষ মরুপ্রান্তরের প্রাঞ্জল রূপ
তাছাড়াও, মনোবিশ্লেষণের সাথে তাঁর পরিচিতি (এই বিষয়ে তিনি বেশ কয়েকটি রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন) এই বইটিকে আরও গভীরতা প্রদান করেছে। যে যে দেশগুলি তিনি পরিদর্শন করেছেন, সেই সব দেশের মানুষ ও সেখানে প্রচলিত রীতিনীতি সম্পর্কে তাঁর গভীর বিশ্লেষণ এই কাহিনিকে সতেজ এবং মহৎ বানিয়েছে। তবে “দ্য রোড টু মক্কা” বললেই মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে সেই মরুভূমির ছবি, যার বর্ণনায় শুধুমাত্র সেখানতার ভূমিরূপ প্রাঞ্জল রূপ পেয়েছে তা-ই নয়, বরং তার পাশাপাশি সেই মরুভূমির যে উপস্থিতি গোটা বইয়ে যে ভাবে মিশে গিয়েছে, তা এক কথায় অসাধারণ।
শুরুতেই সেই ছবি রয়েছে যেখানে ‘দু’জন ব্যক্তি আরবের উটের পিঠে চেপে ধূ ধূ প্রান্তরে অলসভাবে এগিয়ে চলেছেন যেখানে তাঁদের মাথার উপরে সূর্যের শিখা, সবকিছুই ঝকঝকে এবং উজ্জ্বল এবং আলোর মধ্যে সাঁতার কাটছে, এই সহজ অথচ বিস্তারিত বর্ণনা পাঠকের কল্পনায় আরবের মরুভূমির একটি হুবহু ছবি আঁকতে সাহায্য করবে এবং তাঁকে মায়াময়ী বালির জাদুতে আচ্ছন্ন করে তুলবে। আসলে, আসাদের মন্ত্রমুগ্ধ করা সহজ কিন্তু জোরাল ভাষাই হল এই বইয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এবং শুধুমাত্র এই কারণেই গোটা বইটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। এই বইয়ের প্রতিটি লাইন পড়ার সময় পাঠকের মন যে ছবি দেখতে পাবে তা উপভোগ করার জন্য এবং যে হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা “দ্য রোড টু মক্কা” বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার জন্য এই বইয়ের কোনও বিকল্প নেই।