জন্মের পর মানুষকে শিক্ষালাভ, চরিত্র গঠন এবং জীবনধারনের জন্য বিবিধ কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়, আর চলার এই পথে সদাচরণ, বিনয়, নম্রতা ইত্যাদির সমন্বয়ে স্বভাবে যে বৈশিষ্ট ফুটে উঠে, তাকে আদবকায়দা বলে।
এই আদবকায়দা তথা চরিত্র গঠন প্রক্রিয়া জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়ে যায়। এমনকি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ও পিতামাতার গুণাবলী সন্তানের মধ্যে বিকশিত হয়।
তাই সন্তানের সুশিক্ষা ও তরবিয়তে পিতামাতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানসন্ততি পিতামাতার দর্পনস্বরূপ।
পিতামাতা সন্তানের সাথে শৈশবে যে ব্যবহার করবেন, তাদের মধ্যেও সেই চারিত্রিক গুণাবলী বিকশিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাল্যকাল থেকেই শিশুর গ্রহণ ও অণুকরণ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। শিশু যা দেখে তারই অনুকরণ করতে শেখে।
তাই তাদের সঙ্গে সর্বদা ভাল আচরণ করা উচিত। এমনকি তাদের সামনে এমন কোন আচরণ প্রদর্শন করাও ঠিক না যা তাদের প্রতি মন্দ প্রভাব পড়বে।
সন্তানদের জন্য সব সময় দোয়া করতে হবে। কেননা সন্তানদের জন্য পিতামাতার দোয়া জাদুর মতো কাজ করে। তাই শিষ্টাচারপূর্ণ আচার-আচরণ শেখার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত।
মহানবী (সা.) পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কোনো পিতা তার পুত্রকে উত্তম শিষ্টাচার অপেক্ষা অধিক শ্রেয় আর কোনো বস্তু দান করতে পারে না’ (তিরমিজি)।
তাই পিতামাতার উচিত হবে সন্তানদের জন্য সম্পদ জমানোর চিন্তায় বৈধ-অবৈধ পথের অনুসরণ না করে বরং সন্তানদের উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করা।
হাদিসে উল্লেখ আছে, এক সাহাবী মহানবীর (সা.) কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সন্তানের ওপর পিতামাতার কি হক বা দাবি আছে?
তিনি (সা.) বললেন, তারা উভয়েই তোমার বেহেশতও এবং দোজখও’ (ইবনে মাজাহ)।
সন্তান ভাল হবে না খারাপ হবে তা নির্ভর করে পিতামাতার কাছে। সন্তান যে পরিবেশে বড় হবে তাই সে শিখবে। পিতামাতা যদি আদর্শবান হোন এবং ধর্মীয় নিয়মকানুন অনুযায়ী চলেন এবং সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেন তাহলে সন্তান অবশ্যই ভাল হবে।
আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবীতে ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি দিয়ে থাকেন পরীক্ষা করার জন্য। অনেককে আল্লাহতায়ালা প্রচুর ধনসম্পদ দান করেন ঠিকই কিন্তু সেই ধনসম্পত্তির সঠিক ব্যবহার না করার ফলে দেখা যায় পুরো বংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
আবার কাউকে সন্তানসন্তুতি দেন ঠিকই কিন্তু তাদেরকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করার ফলে এই সন্তান তার জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
সন্তানসন্তুতি যদি প্রকৃত নৈতিকগুণ সম্পন্ন না হয় তাহলে মাতাপিতার জন্য তা একটি আজাব ছাড়া কিছুই না।
জীবনবিধান আল কোরআনের সুরা কাহাফের ৪৬ আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি দুনিয়ার সৌন্দর্য। এ সন্তানসন্তুতি যদি আদর্শ চরিত্রের না হয় তাহলে তা হয় মাবাবার জন্য পরীক্ষার কারণ, দুঃখের বোঝা।’
এজন্যই আল্লাহতায়ালা কোরআন করিমে মুমিনদেরকে হুশিয়ার করে বলেছেন, ‘আর জেনে রাখ, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতি পরীক্ষার কারণ’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৭)।
আরো ইরশাদ করা হয়েছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন থেকে বাঁচাও’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ৬)।
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় যে খবরটি নিয়মিত থাকেই তা হল চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা, ইত্যাদি। পত্রিকার পাতায় এই খবরগুলো খুব ভালো করে স্থান দখল করে নিয়েছে।
এমন কোনো দিন বাদ যায় না যে, যেদিন এসব খবর প্রকাশ না পায়। এসব অপকর্ম যারা করে তারা তো কোনো না কোনো পিতামাতারই সন্তান।
এছাড়া তারা অবশ্যই কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী। সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, কোনো ধর্মেই এধরণের গর্হিত অপরাধকে অনুমতি দেয় না।
আমাদের সন্তানদের এত অবক্ষয় কেন? এর কারণ কি? সমাজে যারা নানান অপকর্মে লিপ্ত তাদের সম্পর্কে যদি আমরা একটু খোঁজ নেই, তাহলে দেখতে পাব যে, হয়তো তাদের পিতামাতা তাদেরকে সেভাবে গাইড করেন নাই, যেভাবে করা উচিত ছিল।
সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে এসবের প্রতি হয়তো আমরা কখনই দৃষ্টি দেয়নি। সন্তানদের সম্পর্কে কোনো চিন্তা করি না বলেই যত ধরণের ঘৃণ্য কাজ আছে তাদের মাধ্যমে আজ সংঘঠিত হচ্ছে।
আমাদের সন্তান সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন থাকি এবং উত্তম শিক্ষা প্রদান করি, তাহলে কোনো সন্তানের পক্ষে সম্ভব হবেনা অন্যের ক্ষতি করা।
আমরা যদি নেক সন্তান রেখে যেতে পারি, তাহলে দেশ ও জাতির জন্য তা যেমন কল্যাণকর হবে, তেমনই আমাদের মৃত্যুর পরও এ সন্তান আমাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হিসেবে থেকে যাবে।
সন্তানসন্ততি আল্লাহতায়ালার দান। কোনো সন্তানই জন্ম থেকে খারাপ হয় না।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা পিতামাতার অবহেলার কারণেই সন্তান মন্দ পথে পা বাড়ায়। এজন্য প্রত্যেক পিতামাতার দায়িত্ব হলো সন্তানকে একেবারে শৈশব থেকেই ধর্মীয় আদব কায়দা শিখানো। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, এ বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করা।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কথায় আছে, কাঁচাতে না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাশ ঠাশ। কথাটি খুবই মূল্যবান।
কাদামাটি উত্তমরূপে ছেনে সুন্দর ছাঁচে ফেলে যেমন ইচ্ছেমত সুদৃশ্য জিনিস তৈরী করা যায়, তেমনি মানবের শৈশব কালে উত্তম শিক্ষার মাধ্যমে উত্তম মানুষ তৈরী করা সম্ভব।
তাই আসুন, আমাদের সন্তানদের প্রতি শৈশব থেকেই বিশেষভাবে দৃষ্টি দেই। সন্তানরা যেন কোনভাবে মন্দ পথে পা না বাড়ায় সে বিষয়ে আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এর তৌফিক দিন, আমিন।