রহস্যময় আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামের অবস্থান নিয়ে বাকি পৃথিবীর সেই অর্থে তেমন ধারণা নেই। ইসলামিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে বসলেই আমরা মূলত আরব, তুর্কী বা এশিয়ার কথা ভাবি। খুব বেশি হলে উত্তর আফ্রিকা অর্থাৎ সাহারা অঞ্চলের কথা ভাবি। কিন্তু বাকি আফ্রিকাতেও যে ইসলামের প্রসার হয়েছে সেই বিষয়টা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। এমনকি, সাহারা অঞ্চলের মুসলমান ভাই বেরাদররাও বেশির ভাগ সময়েই বাকি আফ্রিকার ইসলাম ধর্মের কথা খেয়াল রাখতে পারে না।
আসলে খতিয়ে দেখলে এতে ঐতিহাসিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আফ্রিকার বিষয়ে লিখতে গিয়ে তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু জায়গার বাইরে বেরোতে পারেননি, ফলে বাইরের দুনিয়ার জনমানসের কাছে আফ্রিকার সেই অঞ্চলগুলোই উঠে এসেছে বারবার। বাকি আফ্রিকার মানুষের কথা রওয়ে গিয়েছে অন্ধকারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, অনেক ঐতিহাসিকের মতে কায়রোর আমর ইব আল আস মসজিদ নাকি আফ্রিকার প্রথম মসজিদ। সম্ভবত এই ঐতিহাসিকদের জানা নেই যে আফ্রিকাতে ইসলাম ধর্মের শিকড় ও ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ইসলামের পবিত্র শহর মদিনার থেকেও প্রাচীন আফ্রিকায় ইসলামের প্রসার। প্রথিবীর বুকে ছড়িয়ে থাকা নানা ইসলাম সাহিত্য ও ধর্ম গ্রন্থে তার প্রমাণ রয়েছে।
মক্কা পরিত্যাগী সাহাবাদের অবদান
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন তার পাঁচ বছরের মধ্যে মক্কায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়। তৎকালীন মক্কার শাসক যিনি ছিলেন তিনি বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, ইসলামের এক ঈশ্বরবাদের ধর্ম তার পছন্দ না হওয়ায় মুসলমানদের ওপর দমন পীড়ন শুরু হয়। মুসলমানরা পরিবার সমেত মক্কা পরিত্যাগ করতে শুরু করে। নবী হজরত মহম্মদ (সাঃ) নিজে দশ এগারো জন পুরুষ ও চারজন মহিলার এক দল গঠন করে শুবায়া বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। এই শুবায়াই বর্তমানে জেদ্দা নামে পরিচিত।
শুবায়া বন্দর থেকে এই দলটি ইথিওপিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করে। ইথিওপিয়ার আকসুম বা আল হাবাশা রাজ্য ছিল তাঁদের গন্তব্য। মহানবী (সাঃ) জানিয়েছিলেন যে ইথিওপিয়ার শাসক অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও ন্যায়ের পথিক। অতঃপর, নবীজির কথায় অটুট ভরসা রেখে প্রথম পরিযায়ী মুসলমানরা আল হাবাশার শাসক নাজাশি আল হামাহর দরবারে পৌঁছয়। এই দলে রুকায়া (মহান নবীর কন্যা) ও তাঁর স্বামী উথমান ইব আফফান ও ছিলেন।
প্রথম দলটিকে অনুসরণ করে মক্কা থেকে পরবর্তীকালে প্রায় শতাধিক ইসলাম ধর্মাবলম্বি মানুষ আফ্রিকার উপকুলে পৌঁছয়। তাঁদের নেটা জাফর আবু তালেব সুচতুর বাক্যালাপের মাধ্যমে আল হামাহের মন জয় করলে তিনি এই পরিযায়ী মুসলমানদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন।
মক্কা থেকে আবিসিনিয়া ইথিওপিয়ায় এই দুই পরিযানের কথা প্রায় সব সুরাতেই পাওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবীর পরবর্তী প্রজন্মের কথায় সেভাবে আফ্রিকার উল্লেখ পাওয়া যায় না, ফলে ঐতিহাসিকরাও সেভাবে আফ্রিকার কথা উল্লেখ করেননি। এর আরেকটা কারণ, এই মানুষগুলোর জীবনযাপন সম্পর্কে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি, তাই হয়তো এদের বিষয়ে কিছু বলা সেভাবে সম্ভব হয়নি।
আবিসিনিয়ার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কথা
বিশদে গবেষণা করে এটা জানা যায় যে আফ্রিকাতে বাস করতে শুরু করা এই ইসলাম ধর্মাবলম্বি মানুষগুলো বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করতেন। সামাজিক চাপ, আক্রমণ, বহু ঈশ্বরবাদী উপজাতির আক্রমণ ইত্যাদি থেকে মুক্ত ছিলেন এরা।
অন্যদিকে, নবীর কাছের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মানুষ ছিলেন এই পরিযায়ী মানুষগুলোর মধ্যে এবং তারা ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক একজন উলেমা ছিলেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় তাঁরা ইসলাম ধর্মের সম্প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। সেক্ষেত্রে কারা হয়েছিল তাঁদের প্রথম শিষ্য? অবশ্যই আফ্রিকার কালো উপজাতীয় মানুষ।
শান্তি ও ইসলাম হাতে হাত রেখে ছড়িয়ে পড়েছিল আফ্রিকার বুকে।
আফ্রিকার ইসলাম সম্প্রদায় ও নবী হজরত মহম্মদ (সাঃ) -এর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি নাজাশি আল হামাহ ও ইসলাম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদের মধ্যে সুমধুর বন্ধুতপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
একটি ঘটনার মাধ্যমেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়
দ্বিতীয় পরিযানের অল্প কিছুদিন পরেই, আমর ইব আল আস সদলবলে আল হামাহের দরবারে এসে উপস্থিত হন। তখনও তিনি কঠোর ইসলাম শাসক ও আফ্রিকা বিজেতা হিসাবে পরিচিতি পাননি। তিনি আল হামাহকে অনুরোধ করেন আফ্রিকার পরিযায়ী মুসলমানদের তাঁর হাতে তুলে দিতে। বিনিময়ে তিনি উপহার হিসাবে সোনা ও মক্কার বিখ্যাত চামড়ার দ্রব্য প্রদান করেন।
আল হামাহ জানান তিনি আগে জাফার তালেবের কথা শুনবেন। আল আস জানতেন জাফরের বাকপটুত্বের কথা, তাই তিনি জাফর ও তাঁর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল হামাহকে উসকাতে চান। তিনি জানান যে জাফর ও তাঁর সম্প্রদায় নিয়মিত খ্রিস্ট ধর্মের অপমান করে থাকে। আল হামাহ ও তাঁর সভাসদরা যিশুর উপাসক হলেও শান্ত ভাবে আল আস-কে জানান যে তাঁরা আগে জাফরের কথা শুনতে চান।
জাফর এসে সততার সঙ্গে জানান যে ইসলামের মানুষও যিশু ( আলায়হি আল সালাম) ও মাতা মরিয়ম ( আলায়াহা আল সালাম)-কে প্রভূত সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। নাজাশি আল হামাহ এত প্রীত হন, তাঁর চোখ জলপূর্ণ হয়ে আসে। তিনি জানান যে তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের উৎস এক, একেশ্বরবাদ।
অতঃপর তিনি আফ্রিকার মুসলমান সম্প্রদায়কে সারাজীবন সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
আল হামাহ ও জাফরের বন্ধুত্ব এত গভীর হয়ে ওঠে যে কথিত আছে জাফরের পত্নী আসমা উমায়া আল হামাহের কনিষ্ঠ সন্তানের ধাত্রীজননী হয়েছিলেন। শুধু তা নয়, ৬ হিজরি সনে আল হামাহ সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
আবিসিনিয়া থেকে মদিনা
সেই সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকায় ইসলামের প্রসার আরও বেড়ে যেতে থাকে। ইসলাম সম্প্রদায় আল হামাহকে এক রক্তক্ষয়ী গৃহ যুদ্ধের সময় সাহায্য করে। অতঃপর মদিনার পত্তন হলে এই ইসলাম সম্প্রদায় আস্তে আস্তে মদিনায় পাড়ি দেয়।
ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া ও আবিসিনিয়ার গ্ররামে গ্রামে এখনও ইসলামের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। কবর থেকে আরম্ভ করে ছোট ছোট মসজিদ, মানুষের জীবনযাপনে বেঁচে রয়েছে ইসলাম।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায় উত্তর ইথিওপিয়ার নেগাশের নাজাশি মসজিদের কথা। ২০১৮ সালে তুরস্কের সরকার মসজিদটির সংস্কার করে। মসজিদটিতে পনেরোটি প্রাচীন সমাধি রয়েছে। স্থানীয়দের কথা অনুসারে একটি সমাধি মহান নাজাশি আল হামাহ-এর। যিনি ৯ হিজরি সনে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্বয়ং নবীজি শোকপালন করেছিলেন।
বাইরের দুনিয়ার কাছে আফ্রিকা এখনও রহস্যময় এক মহাদেশ, কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম একজন মুসলমান শাসক কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশ থেকেই আগত।