ইসলামের ইতিহাস বলতে ইসলাম ধর্মের উদ্ভবের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়কাল পঞ্জী অনুসারে ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী সভ্যতার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে বুঝানো হয়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক স্বীকার করেন যে খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর শুরুতে মক্কা ও মদীনায় ইসলামের উৎপত্তি। মুসলমানরা ইসলামকে ঈসা, শলোমন, দাউদ, মূসা, আব্রাহাম, নূহ ও আদমের মত নবীদের মূল বিশ্বাসের প্রত্যাবর্তন হিসেবে বিবেচনা করে।
ইসলামের আবির্ভাবের জন্য আরবের বিশেষত্ব
বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিকের মতে, তখনকার সময় একজন নবীর আগমন এবং তার সফলতা লাভের জন্য আরব দেশ যথেষ্ট উপযুক্ত স্থান ছিল। ইসলামী আন্দোলনের জন্যও তা একটি উর্বর ভূমি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। এজন্যই সেখানে ইসলামের বিজয় সম্ভবপর হয়েছিল। তাদের মতামত অনুসারে ইসলামের ব্যাপক প্রসার সম্ভব হয়েছিল নিম্নে উল্লিখিত কারণে,
- এটি সুস্পষ্ট যে, কোন মতাদর্শের বিজয়ের জন্য কোন একজন ব্যক্তির জীবনই যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন একদল যোগ্য লোকের একটি বাহিনী তৈরি যারা সেই মতাদর্শের প্রচার ও প্রসার কাজ আজীবন চালিয়ে যাবেন। আর এ ধরনের কাজ আঞ্জাম দেয়ার ক্ষমতা আরব উপদ্বীপের অধীবাসীদের মাঝে তখন পূর্ণ মাত্রায়ই বিরাজমান ছিল। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টি তা হল আরব বিশ্বের মানব অধ্যুসিত এলাকার প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এবং এর সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নত ছিল। মোহাম্মদের জন্মের আগেই আরব বণিকরা সারা বিশ্বে বাণিজ্য উপলক্ষে ঘুরে বেড়াতো। এজন্যই মূলত নবীর হাতে ইসলামের বিজয় সাধিত হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল।
- আরেকটি গুরুত্ব ছিল আরবি ভাষার। বিশ্বের অন্য কোন ভাষী সেই সময়ে এতটা উৎকর্ষ লাভ করেনি যা চিরকাল অপরিবর্তিত রাখা সম্ভবপর। তদুপরি সেই সময়টা ছিল আরবি ভাষার চরম উৎকর্ষের কাল।
- আরবরা কোন রাজত্বের অধীনে শৃঙ্খলিত ছিলনা। অন্য জাতির গোলামীর কারণে মানুষের মুক্তচিন্তা ও তদসংশ্লিষ্ট যে সকল গুণাবলীর অপমৃত্যু ঘটে তাও প্রশ্নাতীত। আরবের চারদিকে পারস্য ও রোমের মত দুইটি পরাশক্তির রাজত্ব বিস্তৃত থাকলেও কেউ তাদেরকে পরাজিত করতে পারেনি। এতেই আরবদের শৌর্য্য বীর্যের পরিচয় পাওয়া যায় যা ইসলামী আন্দোলনের আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।
- আরবদের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। একটি কথা একবার শুনলেই তা মনে রাখার মত ক্ষমতা তাদের ছিল। এজন্যই ইসলামী শরীয়তের সকল উৎসের হুবুহু সংরক্ষণ সম্ভবপর ছিল যা কোন ধর্মের সার্বজনীনতা এবং সিদ্ধির জন্য একান্তই অপরিহার্য।
- সর্বোপরি আরবরা ছিল দূর্ধর্ষ জাতি। মরুভূমির রুক্ষতা তাদেরকে পুরোমাত্রায় বাস্তববাদী করে তোলে। ফলে যে মতাদর্শে তারা বিশ্বাসী তা গ্রহণ করার পর উপাসনালয়ের এক কোণায় বসে বসে কেবল তার প্রশস্তিকীর্তণ করা তাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব বরং সেই মতাদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্য মাথা তুলে দাঁড়ানো এবং তাতে সর্বশক্তি ব্যয় করাই ছিল তাদের ধর্ম যা ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্যও অপরিহার্য ছিল।
এই মতামতের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকগণ আরো মনে করেন যে,এত সম্ভাবনা সত্ত্বেও ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক বিরুদ্ধবাদিতার মুখোমুখি হতে হয়, কারণ বিরোধী আরবদেরও এই গুণগুলো ছিল এবং তারা মাথা নত করায় অভ্যস্ত ছিলনা। যেহেতু আরবে নেতাদের অত্যধিক সম্মান ছিল এজন্য কেউই চায়নি যে ইসলাম সফলতা পাক এবং এজন্যে তাদের সর্বশক্তি তারা নিয়োগ করে। অর্থাৎ ইসলামের মূল দ্বন্দ্ব্ব্ব ছিল নেতৃত্ব নিয়ে। প্রকৃতপক্ষেই যেকোন মতাদর্শের বিজয়ের জন্য নেতৃত্বই মুখ্য। তবে এই প্রতিকূলতাও মুসলমানদের পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাই সবদিক দিয়েই ইসলামের জন্য আরব ভূমির উর্বরতা স্বতঃসিদ্ধ।